ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

যত ধাপ তত ঘুস

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৩৪

যত ধাপ তত ঘুস

বিভিন্ন সেবা পেতে বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঘুস দিতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে৷ তবে ৯০ ভাগ মানুষ ঘুসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান৷

টিআইবি'র এক গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা যায়।

দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি অমিতোষ পাল৷ ঘুস নিয়ে তিনি একাধিক আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো কাজে ঠিকাদারকে কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে বিল নেয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ঘুস দিতে হয়৷ যত ধাপ তত ঘুস৷ এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷'

অমিতোষ পাল বলেন, 'একটি সড়কের কাজের শুরু হয় দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আর দরপত্র দাখিলের পর থাকে একটি মূল্যায়ণ কমিটি৷ কাজ পেতে হলে শুরুতেই এই কমিটিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুস দিতে হয়৷ কাজটা পাওয়ার পর যাদের কাজ বা যারা টেন্ডার আহ্বান করেছে সেই নির্বাহী প্রকৌশলীকে টাকা দিতে হয়৷ এরপর ফাইলটি উপরে উঠতে যেসব ধাপ পেরোতে হয় তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র৷ এই ধাপগুলো পেরিয়ে কার্যাদেশ পাওয়া যায়৷ প্রতিটি ধাপেই টাকা দিতে হয়৷ তবে সৎ কর্মকর্তাও আছেন, যারা ঘুস নেন না৷ যারা নেন না তাঁদের টেবিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ বেচে যায়৷'

দৈনিক সমকালের এই বিশেষ প্রতিনিধি বলেন, 'কাজটি শেষ হওয়ার পর বা মাঝখানে ঠিকাদারকে বিল পেতে আবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়৷ তখন ওই ধাপগুলো ছাড়াও ঘুসের তালিকায় আরো একটি বিভাগ যোগ হয়৷ আর তা হল অ্যাকাউন্টস সেকশন৷ সব মিলিয়ে যদি এক কোটি টাকার কাজ হয় তাহলে তার ৩০ ভাগ মানে ৩০ লাখ টাকা ঘুস হিসেবেই দিতে হয় ঠিকাদারকে৷ এরপর ভ্যাট ট্যাক্স মিলিয়ে দিতে হয় আরো প্রায় ২০ ভাগ৷ ঠিকাদার যদি কমপক্ষে ১০ ভাগও ব্যবসা করেন তাহলে এক কোটি টাকার টেন্ডারে কাজ হয় ৪০ লাখ টাকার৷ কিন্তু ঠিকাদারা ২০ থেকে ৩০ ভাগ লাভ করেন৷ তাই শেষ পর্যন্ত এককোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয় ২০-৩০ লাখ টাকার৷'

তিনি আরো বলেন, 'এ কারণেই একটি সড়ক যেখানে পাঁচ বছর টেকার কথা সেখানে তা এক বছরের বেশি টেকে না৷'

গড়ে ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সেবা নিতে যান৷ ২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের ১৬টি সেবাখাতে ঘুস নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে৷ জরিপে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের৷

জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে ঘুস দেয়ার কথা জানিয়েছেন৷ আর ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷

জরিপটি হয় ২০১৫ সালে৷ জরিপে বলা হয়, জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ৷ তুলানমূলক চিত্রে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি ঘুস দিতে হয়েছে সেবা খাতে৷ টিআইবি এরপর আর ঘুসের জরিপ করেনি৷ তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷

ওই জরিপে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালে পাসপোর্ট খাতে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘুস বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন৷ ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশকে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে ঘুস দিতে হয়েছে৷ আর পাসপোর্ট অফিসের ১০০ জনের মধ্যে ৭৬ জনই ঘুস নিয়েছেন৷

২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন খাতে প্রায় ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ১ হাজার ৭০২ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ১ হাজার ৬১৩ কোটি, বিচারিক সেবা খাতে ৮০৮ কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হয়৷ পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ ঘুসের কবলে পড়লেও এ খাতে ঘুসের পরিমাণগত অবস্থান সপ্তম৷ এ খাতে ঘুস লেনদেন হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা৷ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা৷

গড় হিসেবে গ্যাস সংযোগ নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুস দিতে হয়েছে৷ প্রতিটি খানায় যার গড় পরিমাণ ২৭,১৬৬ টাকা৷ এছাড়া বিমা খাতে ১৩,৪৬৫ টাকা, বিচারিক সেবায় ৯,৬৮৬ টাকা এবং ভূমি প্রশাসনে ৯,২৫৭ টাকা দিতে হয়েছে৷দেশে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ও ঘুসের পরিমাণ উভয়ই বাড়ছে৷ ঘুস দিতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ৷ ঘুসের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ৷ পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি ঘুসের শিকার হন৷ আর শহরের চেয়ে গ্রামে ঘুসের শিকার মানুষের সংখ্যা বেশি৷

টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'জরিপে এটাও উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের ৬৭.৮ শতাংশ মানুষ ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷ এরকম হওয়ার অন্যতম কারণ হল ঘুস খেলে বা দিলে যে শাস্তি পেতে হয়, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, এটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানোর সময় আশা করা হয়েছিল ঘুসের প্রবণতা কমবে৷ কিন্তু কমেনি৷ আর ঘুস খাওয়ায় সাথে অর্থনৈথিক দুরাবস্থার সম্পর্কও এখানে প্রমাণিত নয়৷ কারণ যে যত বড় পদে থাকেন তিনি তত বেশি ঘুস খান৷'

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'দুর্নীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা মূল ভূমিকা পালন করে৷ কিন্তু ঘুসের ক্ষেত্রে সেটা নাও হতে পারে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে ঘুস এখন আর সামাজিকভাবে নিন্দিত নয়৷ এটা অনেক সময় বাহবাও পায়৷ যা ভযাবহ৷'

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুস বিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল বলেই মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান৷ 'টিআই-এর এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ নিরাপত্তা ও ভরসা পেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়৷'

বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশে ঘুস সংস্কৃতি কমে আসার একটি শুভ লক্ষণও দেখা গেছে৷ তা হল যে খাত যতটা বেশি ডিজিটালাইজড হচ্ছে সেই খাতে ঘুস তত কমছে৷ বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে মানুষকে সেবা পেতে তেমন ঘুস দিতে হয় না৷ তাই ঘুস বন্ধে বিভিন্ন সেবা খাততে দ্রুত জিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক৷

  • সর্বশেষ
  • পঠিত