ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩০ মিনিট আগে
শিরোনাম

সরকারি চাকরি আইনের খসড়া চূড়ান্ত

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২০ মে ২০১৮, ০৯:৪৪  
আপডেট :
 ২০ মে ২০১৮, ১০:৪০

সরকারি চাকরি আইনের খসড়া চূড়ান্ত

রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ারে জনস্বার্থে অনধিক ১০ শতাংশ পদে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে জনবল নিয়োগের বিধান রেখে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ইতোপূর্বে রাষ্ট্রপতির কোটায় সচিব পদে ১০ শতাংশ জনবল নিয়োগ দেয়া হত। এছাড়া কোনো কর্মচারি ফৌজদারি অপরাধের কারণে এক বছরের অধিক মেয়াদে কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণকৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ বরখাস্ত বা অপসারণ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বিশেষ কারণ বা পরিস্থিতি রয়েছে- তা হলে তিনি ওই ব্যক্তিকে ওই শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবেন। সেই ক্ষেত্রে ওই কর্মচারি পুনরায় চাকরিতে বহাল হবেন।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ লাভের একমাত্র মানদণ্ড ও ভিত্তি হিসেবে মেধা এবং উম্মুক্ত প্রতিযোগীতা স্থির করা হয়েছে। পদোন্নতির মানদণ্ড ধরা হয়েছে কর্মচারির মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ এবং সন্তোষজনক চাকরি। তবে সন্তোষজনক চাকরির কোনো সংজ্ঞা নেই। উল্লিখিত বিধিবিধান রেখে সরকারি কর্মচারি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। যা শিগগিরই অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে।

সরকারি চাকরি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্যিকভাবে পদের বেতন, কর্মপরিধি, নিয়োগ পরীক্ষার ধরণ, বিষয়, নম্বর বিভাজন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নূন্যনতম নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নহে এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করা যাবে না।

যে সব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মকমিশনের কিংবা সরকারিভাবে গঠিত কমিটির সুপারিশ নেয়া বাধ্যতামূলক, তা প্রতিপালন ব্যতিরেকে ওই সব পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করলে কিংবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কাউকে পদোন্নতি দেয়া যাবে না।

সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ কাল হবে ২ বছর এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগদানের তারিখ থেকে ১ বছর। নিয়োগকারি কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট না হলে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ কাল শেষে চাকরির অবসান করতে পারবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে পূর্বের পদে প্রত্যাবর্তন করানো যাবে। এই ক্ষেত্রে কোনো ধরণের কারণ দর্শানোর প্রয়োজন হবে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তিকে, কর্মচারিকে কিংবা কর্মচারিগণকে প্রজাতন্ত্রের কর্মের কোনো পদে নিয়োগ, বদলি, প্রেষণে নিয়োগ কিংবা পদায়ন করা যাবে না। অন্যদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে সরকারি কর্মচারির চাকরির অবসান হবে। তবে তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেয়া হবে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা রুজুর প্রয়োজন হবে না।

খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কর্মচারিদের মধ্যে পারষ্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। কোনো পদে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সুষ্পষ্ট বিধান না থাকলে বা জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সম্ভব না হলে কর্তৃপক্ষ যা উপযুক্ত মনে করবে, তার ভিত্তিতেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মচারিরা জানান, এখানে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের সুষ্পষ্ট বিধান থাকা জরুরি। অন্যথায় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকে কর্মচারিকে তার প্রায় অধিকার বঞ্চিত করার সুযোগ পাবে। উদ্বৃত্ত কর্মচারিদের আত্মীকরণ করা হবে। সমপদে না হলে একধাপ পরের পদে আত্মীকরণ করা হবে। তবে বেতন ভাতা আগের পদের হিসেবে পাবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কাউকে আত্মীকরণ করা যাবে না। আত্মীকরণকৃত কোনো কর্মচারিকে কোনো ধরণের পরীক্ষা, যোগ্যতা যাচাইয়ের কোনো পরীক্ষা বা বয়সসীমা অর্জনের শর্তে আত্মীকরণ করা যাবে না। একজন কর্মচারিকে একাধিকবার আত্মীকরণ করা যাবে না। তবে সরকার চাইলে আত্মীকৃত কর্মচারির চাকরির শর্ত সংক্রান্ত বিষয়ে এক বা একাধিক আদেশ জারি করতে পারবে।

কোনো সরকারি কর্মচারি আচরণ, শৃঙ্খলা জনিতকারণে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে লঘু ও গুরুদণ্ড আরোপের বিধান রয়েছে আইনটিতে। এতে বলা হয়েছে, লঘুদণ্ড হিসেবে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা, বেতন স্কেল নিম্নধাপে অবনমিতকরণ করা হবে। গুরুদণ্ড হিসেবে নিম্ন পদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনতিমকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।

কোনো কর্মচারির ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হলে দায়ী ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। প্রয়োজনে তার বেতন ভাতা থেকে আদায় করা হবে। তাতেও সম্ভব না হলে কর্মচারির বিরুদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি এ্যাক্ট ১৯১৩ এর অধীন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অভিযুক্ত কর্মচারি, শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন এবং কর্তৃপক্ষ যে রায় দেবেন তা বহাল থাকবে। সেই ক্ষেত্রে শাস্তি বহাল থাকা বা বাতিল করার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের। রাষ্ট্রপতির রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল চলবে না।

কোনো সরকারি কর্মচারির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির পর তিনি নির্দোষ প্রমানিত হলে তাকে চাকরিতে পুনঃবহাল করতে হবে। তার বিরুদ্ধে গৃহীত সকল দণ্ড প্রত্যাহার করা হবে। তবে মামলা শেষ হতে তিনি অবসরে যাওয়ার বয়সে উপনীত হলে, তাকে চাকরিতে আর বহাল করা যাবে না। তিনি শুধু আর্থিক সুবিধাদি পাওনা হবেন।

কোনো সরকারি কর্মচারির বিরুদ্ধে দায়িত্বপালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইন ২০০৪-এর অধীনে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সরকার বা নিয়োগকারি কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারাটি ইতোপূর্বেও একাধিকবার সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছিলো। কোনো কর্মচারির বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা হবে না বলে বিধান রাখা হয়েছে।

কোনো কর্মচারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ছুটিতে গেলে বা অনুপস্থিত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ১ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। অফিস চলাকালে বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করলে প্রত্যেকবারের জন্য ১ দিনের মূল বেতনের সমান অর্থ কাটা যাবে। অফিসে উপস্থিতির ক্ষেত্রে ২ দিন বিলম্বে উপস্থিত হলে ১ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারিরা জানান,এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেন পদস্থ সরকারি কর্মচারিরা। তারা সব সময় দেরিতে অফিসে আসেন বলে একাধিক কর্মচারির বক্তব্য। অফিস প্রধানতো মিটিংয়ের অযুহাতে বরাবরই দেরিতে অফিসে ঢোকেন। তাছাড়া অনেক কর্মকর্তা এমন কি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অভ্যাসগতভাবেই রাত ১০ পর্যন্ত অফিস করেন। সেই ক্ষেত্রে সাধারণ কর্মচারিরাও গভীর রাত পর্যন্ত তাদের জন্য অফিসে অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া প্রতি বছর রমজান মাসে গড়ে সব পর্যায়ের সরকারি কর্মচারিরা দেরিতে অফিসে ঢোকেন এবং সকাল সকাল বেরিয়ে যান। অথচ নিয়ম অনুসারে অফিস প্রধান সবার আগেই অফিসে আসার কথা।

কোনো কর্মচারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়া সরকারি কর্মচারিরা অনুদান, সহায়তা, সুদমুক্ত ঋণ এবং অগ্রিম প্রদান সুবিধা পাবেন। সরকারি কর্মচারির পরিবার বলতে- কর্মচারি পুরুষ হলে স্ত্রী বা স্ত্রীগণ, মহিলা হলে তার স্বামী, কর্মচারির সঙ্গে বসবাসরত এবং তার ওপর নির্ভরশীল সন্তান সন্ততিগণ, পিতা-মাতা, দত্তক সন্তান, নাবালেগ ভাই, অবিবাহিতা, তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা বোন পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।

চাকরি বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে, যে কোনো কর্মচারি অবসরে যাওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করতে পারবেন। একবার লিখিত আবেদন করলেই তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং কোনোভাবে তা আর সংশোধন করা হবে না। ইতোপূর্বে তৈরি করা খসড়ায় অবসরের বয়স নির্ধারণ করা হয় ২০ বছর। চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করার পর পর অবসরে গেলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই কর্মচারি ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা দেয়া চাঁদা, চাঁদারসুদ ছাড়া অন্য কোনো সুবিধাদি পাওনা হবেন না। তবে সরকার বিশেষ বিবেচনায় অনুকম্পা হিসেবে অর্থ প্রদান করতে পারবে। অবসর সুবিধাভোগী কোনো কর্মকর্তা গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত হলে বা গুরুতর কোন অসদাচরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে সরকার তার অবসর সুবিধা সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে স্থগিত বা প্রত্যাহার করতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মচারি জানান, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরও সরকারি কর্মচারি আইন ঘষামাজা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া তৈরি করে তা আইন আকারে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আইন প্রণয়নের ইতিহাসে এটি নজীরবিহীন ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন খোদ জনপ্রশাসনের কর্মচারিরাই। তারা বলছেন একটি আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে এত টাকা খরচের কোনো ঘটনা আইন প্রণয়নের ইতিহাসেই নেই।

জানা যায়, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সব আইনের খসড়া তৈরি ও যাচাই বাচাই হয় মন্ত্রণালয়ের বিধি ইউং থেকে। এমন কী অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা আইনের খসড়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে তা বিধি ইউং থেকেই দেয়া হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ রহস্যজনক কারণে সরকারি কর্মচারি আইন প্রণয়নের জন্য একটি প্রকল্প করা হয়েছিলো। ওই প্রকল্পটি রাখা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এন্ড ট্রেনিং(সিপিটি) ইউংয়ের আওতায় গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু অনুমোদন লাভের পরও আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।

ডিপি/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত