রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবাধে চলছে বাল্যবিয়ে
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০১৮, ১২:৫৫ আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৮, ১৩:০২
মর্জিনা বেগম, বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কুতুপালং ক্যাম্পে থাকেন। গত মাসেই ১৪ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মর্জিনা বেগমের ভাষ্য, ‘মাইয়ারে সহরে সহরে বিয়া দিলে হিয়ান হইলো সুন্নত’। অর্থ্যাৎ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া সুন্নত।
তিনি বলেন, ‘বার্মার দেশের লোকেরা ছেলে মাইয়ারে সকালে সকালে বিয়া দিয়া দেয়। বাংলাদেশের এলাকাতে হইলো ছোট মাইয়াগো বিয়া দেয় না। তাগো পড়ালেখা করায়। বার্মার দেশের লোকেরা এডি চায় না’।
বিবিসি’র প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন? কিন্তু সেই কেন’র কোন উত্তর পাওয়া গেলো না কুতুপালং ক্যাম্পে।
মর্জিনা বেগম যেমন সহজ করে বলেছিলেন তেমনি সহজ করেই ‘কেন’ প্রশ্ন শুনে হাসতে আরম্ভ করলেন।
মেয়েদের আগেভাগে বিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে আলাপ তুলতে গিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলো সেখানে। ক্যাম্পে চোখে পড়লো অসংখ্য কিশোরীর কোলে শিশু।
বাল্যবিয়ে হয় তো তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি। তবে ভিন্ন কারণও রয়েছে। মোহাম্মদ সেলিম, গত অক্টোবরে মিয়ানমারের কারারুপাং এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কুতুপালং ক্যাম্পে ঠাঁই নিয়েছেন।
অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত পরিবারের এই তরুণ বলেন, তারা যখন মিয়ানমারে বসবাস করতেন তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার প্রচলন। যার মূল কারণ নিরাপত্তা। বাংলাদেশে আসার পরও সেটিই বড় কারণ হিসেবে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘যদি আমার বোনকে আমি বিয়ে না দেই, তাহলে সে এদিক ওদিক চলাফেরা করবে আর ওরা ওর গায়ে হাত বাড়াবে। তাই আমরা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে করে সে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকবে। বাজারে যাবে না, এদিক ওদিক যাবে না। আমরা আমাদের ইজ্জতের জন্য এইটা করতেছি।’
এদিকে কুতুপালং শিবিরের মসজিদে আকসার ইমাম আক্তার হোসেন বলেন, এখানে কিছু পরিবার আছে যাদের ১০-১২ জনের পরিবার। ছোট ঘরে দেখা যায় দুইজন যুবক ছেলে আর দুইজন যুবতী মেয়ে। তখন তাদের দুইটা আলাদা কক্ষ দিতে হয়।
তিনি আরো বলেন, এত ছোট ঘর, সেইজন্য কিছু লোক মনে করে মেয়ে উপযুক্ত হইয়া গেছে। ওদের যদি আমি বিবাহ দিতে পারি তাহলে কিছুটা সুবিধা হবে।
এর কিছুটা ধারনা পাওয়া গেলো মুসতফা খাতুনের ঘরে গিয়ে। ১০ ফুটের আকারের একটি ঘরে থাকছেন তিনি ও তার দশজনের পরিবার। বছরখানেক আগে মিয়ানমারের নাসাগ্রো এলাকা থেকে তিনদিন পায়ে হেটে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তারা।
ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। মাটির উপরে পাটি পেতে রাখা। মুসতফা খাতুন বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষতি সম্পর্কে তিনি ঠিকই জানেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবই জানি কিন্তু কি করবো ছেলে মেয়েরা তো আজকাল পছন্দ করেই বিয়ে করে ফেলছে।’
তার ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে নিজ পছন্দে যে ছেলেকে বিয়ে করেছে তার বয়স ১৭ বছর।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে কথা বলতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে ফেলার প্রসঙ্গটি বারবার সামনে এলো। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্য বিয়ের হার আসলে কতটা সে নিয়ে কোন সংস্থাই সেভাবে তথ্য দিতে পারেনি।
তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি বলে মনে করছেন উন্নয়ন কর্মীরা। কক্সবাজারে ইউনিসেফের কর্মকর্তা অ্যলেস্টেয়ার লসন ট্যানক্রেড বলেন, ‘আপনি জানেন রোহিঙ্গারা সামাজিকভাবে বেশ রক্ষণশীল এবং তার যদি একটি ধারনা দেই; আমি সেদিনই ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। সেখানে ছয়জন ইমামের সাথে আমার কথা হচ্ছিলো। তারা সবাই একমত যে প্রথমবার মাসিক হওয়ার পর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া একদম গ্রহণযোগ্য।’
আর যেহেতু বাল্য বিয়ের ক্ষেত্র রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আইনের আওতায় পরেন কিনা সেনিয়ে দ্বিধা রয়েছে তাই এমন বিয়ে প্রতিরোধ করাও কর্তৃপক্ষের জন্য মুশকিল বলে জানান ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা।
ট্যানক্রেড বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু ক্যাম্পে যে রকম অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা হয়, সেখানে এমন আইন প্রয়োগ করা খুবই কঠিন। দেখা যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আয়োজন করে একটা বিয়ে হয়ে গেলো। তবে রোহিঙ্গাদের বাল্য বিয়ে নিয়ে জ্ঞান দেয়ার আগে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এটা সত্যি যে তারা ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। আমাদের চোখে বাল্য বিয়ে যত জঘন্য মনে হোক না কেন ক্যাম্পের জীবন নিরাপত্তাহীন সেটি তো সত্যি।’ তবে রোহিঙ্গারা বাল্য বিয়ে নিয়ে এখন অন্তত খোলামেলা কথা বলছেন। ক্যাম্পের মসজিদে পুরুষদের জন্য সে বিষয়ে বয়ান দেয়া হচ্ছে।
নারীদের সংগেও কথাবার্তা বলার নিরাপদ যায়গা তৈরি করা হয়েছে সকল ক্যাম্পে। মর্জিনা বেগমের মতো নারীরাই সেখানে অংশ নেন। ক্যাম্পের কমিউনিটি সেন্টারে বাল্য বিয়ে নিয়ে নাটিকা গান বাজনাও হয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
ডিপি/