ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

নরসিংদীর অভিযান নিয়ে যা বললেন এলাকাবাসী

  নরসিংদী প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:২৬  
আপডেট :
 ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৩৩

নরসিংদীর অভিযান নিয়ে যা বললেন এলাকাবাসী

শিল্পাঞ্চল হিসেবে খ্যাত নরসিংদীর মাধবদীতে ঘাঁটি করেছে জঙ্গিরা। পুলিশের কাউন্টার টোরোরিজম (সিটিটিসি) ইউনিট সদর উপজেলার শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকা ও মাধবদী ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকায় দুইটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে।

মঙ্গলবার বিকাল ৪টার দিকে ভগীরথপুর এলাকার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। ‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’ নামে এ অভিযানে নারীসহ দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। সেখান থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গিরা সেখানে চারটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মাধবদী ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার আস্তানাটি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ।

‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’ শেষে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, অভিযানে নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা নব্য জেএমবির সদস্য। প্রাথমিকভাবে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত ৩ অক্টোবর এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল তারা। ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার জঙ্গিদের সঙ্গে এখানকার জঙ্গিদের যোগসাজস রয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, নিহতরা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে, নাকি নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা গেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, অপর জঙ্গি আস্তানা মাধবদী গাঙপাড় এলাকায়ও দিনের আলোতে অভিযান চালানো হবে। তাদেরকেও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হবে। আত্মসমর্পণ না করলে আমরা অ্যাকশনে যাবো।

মঙ্গলবার সন্ধায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, দুর্গাপূজা এবং সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জঙ্গিরা বড় ধরণের নাশকতার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। তারা কোথায় হামলা চালাতে পারে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে জঙ্গি আস্তা দুইটির সন্ধান পাওয়া যায়।

মাদবদী গদাইরচর গাংপাড় এলাকায় কখন অভিযান চালানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানিয়েছি। রাতভর চেষ্টা করবো, যাতে তারা অত্মসমর্পণ করে। কারণ, আমরা কোনো হাতহতের ঘটনা দেখতে চাই না। যদি তারা অত্মসমর্পণ না করে, তাহলে দিনের আলোতে সেখানে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা আছে।

এদিকে জঙ্গি আস্তানার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকাবসীর মধ্যে আতংক দেখা দেয়। জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকা সিলেট মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। সকাল থেকেই জঙ্গি আস্তানা দুইটির আশাপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের বাসার অনেকে জিম্মি হয়ে পড়েন। যারা ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছে তাদের অনেকে বাসায় প্রবশে করতে পারেন নাই।

সোমবার রাত ১০ টার পর থেকেই বাড়ি দুইটি ঘিরে রাখে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিস) ইউনিটের সদস্যরা। ভোর ৬ টার দিকে আস্তানা দুইটির আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। সরিয়ে নেয়া হয় এলাকার বাসিন্দাদের। শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মাকের্টের পাশের বাড়িতে সকাল ১০টার পর অভিযান শুরু করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বাড়ির মালিক বিল্লাল মিয়া। তিনি ড্রাইং ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ইভা টেক্সটাইল মিলের মালিক তিনি। পঞ্চম তলার ৫ তলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে পায় পুলিশ।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিক ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। সকাল ৯টা ৫৩ মিনিটে শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মাকের্টের পাশে অবস্থিত ঘটনাস্থলে আসেন সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। রাতেই সেখানে আসেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জেলা পুলিশ, অ্যান্টি টোরোজিম ইউনিট, সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াট এবং সিআইডির ক্রাই সিন ইউনিটসহ আইপ্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরা একে একে ঘটনাস্থলে আসেন। অভিযান শুরুর পর দিনভর থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। জঙ্গিরা বাসার ভেতর থেকে এবং পুলিশ বাইরে থেকে জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বেলা সাড়ে ১২টার পর আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের জানান, আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপারেশন শেষ করতে পারবো। কী ধরনের অস্ত্র বা বিস্ফোরক আছে সে বিষয়ে কিছু ধারণা আছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এ তথ্য নিশ্চিত হলেও কী পরিমাণ অস্ত্র গোলা-বারুদ মজুদ আছে তা নিশ্চিত নই। কাউন্টার টেরিজম ইউনিট এখানে অপারেশন পরিচালনা করছে। এ অভিযান শেষ হলে ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার নিলুফা ভিলায় অপারেশন শুরু হবে। কতজন জঙ্গি আছে তা নিশ্চিত নই। তবে একাধিক জঙ্গি আছে। অপারেশনের প্রটোকল অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা নেয়ার দরকার সেসব ব্যবস্থা নিয়েই অপারেশন পরিচালনা করছি। জঙ্গীদের আত্বসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সে সুযোগ নেয়নি। প্রটোকল অনুযায়ী ঘ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এরপর গুলি বর্ষণের মধ্য দিয়ে মূল অপারেশন শুরু করা হয়।

অপারেশনের নাম ‘গর্ডিয়ান নট’ দেয়ার কারণ হিসেবে আইজিপি বলেন, নট মানে হচ্ছে গেরু। এটা এমন জটিল গেরু যা খুলতে কষ্ট হয়। অপাশেনটা খুব জটিল। এখানে পুলিশের চেয়ে জঙ্গিরা সুবিধাজনক আবস্থায় আছে। সুতরাং আমাদের জন্য অপারেশনটা একটু কষ্টকর।

অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা আত্মসমর্পন করেনি। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে অভিযান শুরু হবে। গণবসতি এলাকা হওয়ায় সর্বোচ্চ সর্তকর্তার সঙ্গে অভিযান চলবে।

তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কাউন্টার টেরোরিজমের পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট ও বোমা নিস্ক্রীয়কারী দল অভিযানে যোগ দিয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকার লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, জঙ্গি আস্তানায় সঅনেক বিস্ফোরক দ্রব্য আছে। সেখানে কতজন জঙ্গি আছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

তবে, মঙ্গলবার সকাল থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শেখেরটেকের বাড়িতে চারজন জঙ্গি অবস্থান করেছে। আর মাধবদী পৌরসভার গাঙপাড় এলাকার আফজাল হাজির ‘নিলুফা ভিলা’ নামের ৭ তলা একটি বাড়িতে ৩ জঙ্গি সোমবার রাত থেকে ঘিরে রাখে সিটিটিসি সদস্যরা। ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ‘মিততাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা’ নামের একটি মাদ্রাসা আছে। ভবনটির ৭ তলায় জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করে পুলিশ।

সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিলুফা ভিলায় তিনজন জঙ্গি অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ২ জন নারী ও এক জন পুরুষ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, ‘নিলুফা ভিলা’র ওই ফ্ল্যাটটি গত ৬ মাস আগে নারায়নগঞ্জের আড়াই হাজার এলাকার বাসিন্দা বাসা হাফিজ ভূইয়া নামে এক ব্যক্তি ভাড়া নেয়। সোমবার রাতে আইন শৃংখলা বাহিনার সদস্যর সেখানে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসার ভেতর থেকে লাইট বন্ধ করে দেয়।

দুপুর ১২টার দিকে শেখেরচর বগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকার বাসিন্দা বাদল মিয়া ওরফে বাদল বাবুর্চি জানান, এখানে যে এত বড় জঙ্গি আস্তানা থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। সোমবার রাত ১২ টার দিকে বাথরুম করতে বাইরে বের হলে পুলিশ দেখি। পুলিশ আমার পরিচয় জানতে চাইলে বলি, আমি এখানকার বাসিন্দা। তারপর তারা চুপ করে বাসায় যেতে বললে আমি বাসার ভেতর চলে যাই। এরপর আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৮টার দিক নাস্তা করতে বাইরে বের হই। পুলিশের ব্যারিকেটের এখন বাসায় প্রবেশ করতে পারছি না।

তিনি জানান, সকালে জঙ্গি আস্তানার পাশের বাড়ি থেকে নাজমুল (১৭) নামের একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানা যায়, নাজমুলের মাধ্যমেই জঙ্গিরা বাড়িটি ভাড়া নেয়। নাজমুল শেখেরচর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মুদি দোকানদার। এলাকায় সে খুবই ভাল ছেলে হিসেবে পরিচিত।

বাদল বাবুর্চি জানান, নাজমুলের এক বোনের দেবর ওই জঙ্গিদের ব্যবসায়ী পরিচয়ে নাজমুলের কাছে নিয়ে আসেন। পরে নাজমুলের মাধ্যমে বিল্লাল মিয়ার ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গিরা।

তিনি জানান, জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই আতংকের মধ্যে আছি।

ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার নিলুফা ভিলার পাশের বাড়ির বাসিন্দা ও জেলা আওয়ামীলগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ওরফে আনোয়ার কমিশনার জানান, আমার বাড়ির ঠিক ১০০ গজ দূরে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানে জঙ্গি থাকার বিষয়টি আগে কখনও ভাবতেও পারিনি। কারণ, আমাদের একটি একটি শান্তিপূর্ণ এলাকা। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বা জঙ্গি-নাশকতা আমরা কল্পনাও করি না। ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন নতুন লোকজন আসেন। নতুন কেউ এলে আমরা চাকরি বা ব্যবসা করতে এসেছেন। তাই তাদের ওপর কোনো নজরদারি করি না।

জেডআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত