ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

রৌমারীর তাঁত শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম

  কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০৪

রৌমারীর তাঁত শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চরকাজাইকাটা গ্রামের নিজ বাড়িতে নিজের তাঁতে গভীর মনোযোগে মহিলাদের শীতের চাদর বুনছেন জামাল উদ্দিন (৫৫)। বাপ-দাদার হাত ধরে শেখা তাঁত শিল্পের এ কাজটাই তিনি করছেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর আগে মনের যে উৎফুল্ল চিত্তে মহিলাদের পড়নের হরেক রকমের শাড়ি, পুরুষদের পরনের লুঙ্গি, গামছা, গায়ের চাদর, বিছানার চাদরসহ নিত্য ব্যবহার্য কাপড় তৈরি করতেন, এখন সে উৎফুল্লতা আর নেই। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তৈরি করছেন শুধু মাত্র মহিলাদের শীতকালীন চাঁদর। তার সাথে কাজ করছেন আরো দু’জন শ্রমিকও। আর পাশে বসে চরকায় চাঁদর বুননের সুতা গুটিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম।

জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আগের যুগ আর নেই বাবা। আজ থেকে ১৫ বছর আগেও ২০টি তাঁতে কাপড় বুনেও চাহিদা মেটানো যেত না। আর এখন সব বন্ধ করে দিয়ে মাত্র তিনটি তাঁতে শুধুমাত্র মহিলাদের চাঁদর তৈরি করেও ভালো দামে বেচতে পারছি না। কাস্টমার নেই। তার উপর এনজিওর লোনের কিস্তি। কেমন করে ভালো থাকি বলেন’?

জামাল উদ্দিন আরো বলেন, বর্তমান বাজারে সুতার দাম বেশি, জড়ির দাম বেশি, শ্রমিকের হাজিরা বেশি। অথচ বেশি দামে উপকরণ কিনে কিস্তির টাকার চাপে একজোড়া চাঁদর মাত্র তিনশ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তবে কিস্তির ঝামেলা না থাকলে উৎপাদিত এসব চাঁদর মজুদ করে রেখে শীতকালে বিক্রি করতে পারলে পাঁচশ টাকা জোড়া পাওয়া যায়। তখন একটু লাভ থাকে।

কত টাকা লোন নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়ে সুতা কিনে চাঁদর তৈরি করছি। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ১৩শ টাকা কিস্তি দিতে হয়। সরকার যদি আমাদের অল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমরা চাঁদর মজুদ করে শীতকালে বিক্রি করে লাভ করতে পারতাম।

জামাল উদ্দিনের মতোই হতাশার কথা শোনালেন একই গ্রামের তাঁত মালিক লেবু (৩৫) ও আব্দুস সালাম (৬০)।

আর পার্শ্ববর্তী চরশৌলমারী গ্রামের বন্ধ করে রাখা তাঁত মালিক মোসলেম উদ্দিন জানান, আমাদের নিজস্ব কোন তহবিল নাই। এনজিও থেকে লোন নিয়ে সুতা কিনে আনি। কাপড় তৈরি করে মজুত করতে পারি না। কিস্তির চাপে কম দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে লাভের জায়গায় লোকসানের খেসারত দিতে হয়। তাছাড়া বাকীতে কাপড় বিক্রি করে সময় মতো টাকাও পাওয়া যায় না। এজন্যই বর্তমানে তাঁত বন্ধ করে রেখেছি। তবে সরকার যদি আমাদের ব্যাংক থেকে কম সুদে লোনের ব্যবস্থা করে না দেয় তাহলে আর বাপ-দাদার এ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

এলাকাবাসী জানায়, প্রায় এক থেকে দেড়শো বছর আগে চরাঞ্চলের এই এলাকায় বসত গড়ে তাঁতে কাপড় বুনতে শুরু করেন কয়েকটি পরিবার। তখন চরের জমিতে চাষাবাদ করা ফসল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে সময় এই তাঁতে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারগুলোর দেখা দেখি ঘরে ঘরে তাঁতের প্রসার ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে রৌমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার তাঁত শিল্প গড়ে উঠে। রৌমারীর তাঁতে বোনা নিত্য প্রয়োজনীয় কাপড় হয়ে উঠে রংপুর অঞ্চলের মানুষের প্রধান প্রধান পোশাক। এই কাপড় স্থানীয় পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বড় বড় কাপড় মার্কেট টাঙ্গাইল, বাবু বাজার হয়ে চলে যেতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এরপর রঙ্গিন সুতোয় তাঁতের স্বর্ণ যুগ চলতে থাকে ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত।

এরপর থেকে জীবন-জীবিকার ব্যয় বৃদ্ধিতে আর্থিক টান, সুতার দাম বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়া, বৈদেশিক বাজার সৃষ্টি করতে না পারা, দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পারা, যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক হওয়া এবং সরকারীভাবে কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব তাঁত শিল্প। বর্তমানে এই তাঁতের সংখ্যা কমতে কমতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রায় এক থেকে দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প।

সরেজমিনে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ও বন্দবের ইউনিয়নের চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী, বাঘমারা ও পালেরচর গ্রামের বেশীর ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেলেও অল্প কিছু তাঁত সচল রয়েছে। যার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হবে না।

এব্যাপারে চর শৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান কে এম ফজলুল হক মণ্ডল বলেন, আমার ইউনিয়নের চর কাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী ও বন্দবেড় ইউনিয়নে বাঘমারা, পালেরচরে প্রায় বিশ হাজার তাঁত ছিল। তা বন্ধ হতে হতে এখন এখন সব গ্রাম মিলে সচল তাঁত আছে দুই হাজারের মত।

তিনি আরো বলেন, তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপজেলা সমন্বয় সভায় স্বল্প সুদে ঋণের জন্য রেজুলেশন করে জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু তার কোন অগ্রগতি নেই। ফলে আমার ইউনিয়নের তাঁত গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। এদের জন্য জরুরী ভাবে সরকারী ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সাথে বিদেশে রপ্তানি করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

কুড়িগ্রাম নগরীর ডিএম রহিদুল ইসলাম খান জানান, আমি এক বছর ধরে কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীর দায়িত্বে আছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত রৌমারী উপজেলার কোন তাঁত মালিক আমার কাছে আসেনি। এরমধ্যে গত বছর আমরা শতরঞ্জি প্রকল্পের মাধ্যমে উলিপুরের কিছু নারীকে ট্রেনিং ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছি। তারা পাপস, ওয়ালমেটসহ বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী তৈরি করছে। তাছাড়া আমাদের এখান থেকে তাঁত শিল্পে লোন দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। এটা রংপুর থেকে করা হয়।

এ বিষয়ে রংপুর বিসিক অফিসের প্রমোশন অফিসার ও শতরঞ্জি প্রকল্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা এহসানুল হক বলেন, আমরা কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীর পরামর্শে কুড়িগ্রাম ও উলিপুর উপজেলায় ১শ ৯৫ জন পুরুষ-মহিলাকে ট্রেনিং ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছি তারা শতরঞ্জি সামগ্রী তৈরি করছে। কুড়িগ্রাম বিসিক অফিস যদি মনে করে তাহলে রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পদের ট্রেনিং ও আর্থিক সহায়তা করার সুযোগ আছে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন বলেন, আমি রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পের বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি। সরেজমিনে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে যে রকম সুবিধা দিলে তারা এই তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে স্বাবলম্বী হতে পারবে আমরা সে রকম সুবিধাই প্রদান করবো।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত