ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

মৎস্য অভয়াশ্রমের মাছ হরিলুট, নীরব মৎস্য বিভাগ

  পঞ্চগড় প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৪৪

মৎস্য অভয়াশ্রমের মাছ হরিলুট, নীরব মৎস্য বিভাগ

পঞ্চগড়ের মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোতে চলছে মাছ হরিলুটের মহোৎসব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ঢগার সামনে দিয়েই অবাধে চলছে মাছ চুরি। জেলা মৎস্য বিভাগের তেমন কোন নজরদারি না থাকায় দিনের পর দিন এভাবে মাছ নিধন চলছেই। রাতের অন্ধকারে মাছ চুরির পাশাপাশি এখন দিনেও মাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে একটি অসাধু মহল। প্রভাবশালী মহলের পাশাপাশি মাছ চুরির অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মৎস্য অভয়াশ্রমের কিছু জেলেদের বিরুদ্ধেও। এমনকি মাছ চুরি ঠেকাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমের এক প্রহরী খুন হয়েছেন।

তারপরও থামছে না মাছ চুরি। ক্রমাগত মাছ চুরি হওয়ায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমসহ পঞ্চগড়র মৎস্য অভয়াশ্রমগুলো এখন প্রায় মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মৎস্য অভয়াশ্রমের মাছ অবৈধভাবে শিকার করার পর তা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি ও মৎস্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বাড়িতেও পৌঁছে যায়। দিন দুপুরে অভয়াশ্রমে মাছ ধরার ঘটনা ঘটলেও মৎস্য বিভাগের নীরবতায় জনমানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে।

পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলার ছোট বড় বিভিন্ন নদী ও খালে মোট ১৪ টি মৎস্য অভয়াশ্রম রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সদরের চীন মৈত্রী সেতু সংলগ্ন করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রম, ধুলাঝারি অভয়াশ্রম, দেবীগড় অভয়াশ্রম, পাথরাজ নদীর পাখিপড়া মনি অভয়াশ্রম, বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর বোয়ালমারী অভয়াশ্রম, টেকরামনি অভয়াশ্রম, পঞ্চগড় সদর উপজেলার করতোয়া নদীর নলকুরা অভয়াশ্রম, তালমা নদীর তালমা অভয়াশ্রম ও চাওয়াই নদীর চাওয়াই অভয়াশ্রম, তেঁতুলিয়া উপজেলার করতোয়া নদীর কালিয়ামনি অভয়াশ্রম ও ভেরসা নদীর ভেরসা অভয়াশ্রম। অধিকাংশ অভয়াশ্রমগুলোই করতোয়া নদীতে অবস্থিত।

তবে জেলার মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোর বিষয়ে জেলা মৎস্য অফিসে চার দিন গিয়েও তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আফতাব হোসেনের কাছে তথ্য চাইতে গেলে তিনি দেখিয়ে দেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক আশরাফুজ্জামানকে। আবার সিনিয়র সহকারী পরিচালক আশরাফুজ্জামানের কাছে তথ্য চাইতে গেলে তিনি দেখিয়ে দেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আফতাব হোসেনকে। চার দিন ঘুরে কোন তথ্য মিলেনি তাদের কাছে।

জেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য অভয়াশ্রম দেবীগঞ্জের চীন মৈত্রী সেতু সংলগ্ন করতোয়া অভয়াশ্রম। এই মৎস্য অভয়াশ্রমটিতে ২০০৬ সালে মাছ সংরক্ষণ শুরু হলে ভালভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। ২০১৩ সালে মৎস্য অভয়াশ্রমটি জাতীয়ভাবে স্বর্ণপদক লাভ করে। তারপর থেকেই অভয়াশ্রমের মাছ চুরির অভিযোগ উঠে স্থানীয় কিছু সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ওই অভয়াশ্রম সমিতির অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে। চীন মৈত্রী সেতুর উপর দেখে মাছের সাঁতার দেখতে প্রতিদিন জড়ো হতো পর্যটকরা। এখানে ২ থেকে ২০ কেজি ওজনেরও মাছ দেখতে পাওয়া যেতো। কিন্তু স্বর্ণ পদক পাওয়া এই মৎস্য অভয়াশ্রম এখন মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। জানা যায়, চুরি হওয়া মাছগুলোর ভাগ পৌঁছে যায় বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, মৎস্য বিভাগের কিছু কর্মকর্তাদের বাড়িতে।

সরেজমিনে দেখা যায়, করতোয়া সেতুর পূর্ব পাড়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধের নিচে বিভিন্ন বয়সী লোকজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। কেউ কেউ নদীর অল্প পানির মধ্যে বালির বস্তা ফেলে তার উপর বসে আরাম করে বড়শি ফেলে মাছ ধরে চলেছে। একই অবস্থা পঞ্চগড়ে নলকুরা ও বোদার বোয়ালিমারী অভয়াশ্রমসহ অন্য অভয়াশ্রমগুলোতেও।

নলকুরা অভয়াশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলাতেই অভয়াশ্রমে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে ৩/৪ স্থানীয় যুবক। ক্যামেরা দেখেই বড়শি নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দিনের চেয়ে রাতের বেলাতেই বেশি মাছ চুরি হয়। অধিকাংশ অভয়াশ্রমগুলোতে রাতের গভীরে চুরি হয় মাছ। অভয়াশ্রমের মৎস্যজীবী সমিতি থেকে পাহারাদার নিযুক্ত করলেও তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চলে মাছ ধরা। গত বছরের ২৩ অক্টোবর মাছ চুরিতে বাঁধা দেয়ায় বিশুদাশ (৩৫) নামের ওই মৎস্য অভয়াশ্রমের নৈশ প্রহরীকে হত্যা করে মাছ চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা।

এ বিষয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা চলমান রয়েছে। কোথাও কোথাও সমিতির সদস্যরাও এই চক্রের সাথে জড়িত। কোন অভয়াশ্রমেই মৎস্য বিভাগের কোন নজরদারি দেখা গেলো না। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাকের ঢগা দিয়ে নিয়মিত এভাবে ওই মৎস্য অভয়াশ্রমের মা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিধন করলেও তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোতে অবাধে মাছ চুরি হওয়ায় একদিনে সাধারণ মৎস্যজীবীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৎস্য বিভাগের এই মহৎ উদ্দেশ্যও ভেস্তে যাচ্ছে।

দেবীগঞ্জে ঘুরতে আসা শাহীন আলম জানান, ‘আগে আমি মাঝে মাঝে এখানে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসতাম। সেতুর উপর থেকেই বড় বড় মাছ ভেসে থাকতে দেখা যেতো। শিশুরা এই অভয়াশ্রমের মাছ দেখে খুব মজা পেতো। কিন্তু এখন কোন মাছের দেখাই নেই।’

দেবীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমে দিনের পর দিন একটি চক্র কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে মাছ ধরে করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমটিকে মাছশূন্য করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শক্ত কোন পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। বিশেষ করে মৎস্য বিভাগের কোন নজরদারি নেই।’

দেবীগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল দে সরকার জানান, ‘আমরা এই মৎস্য অভয়াশ্রমের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন আমাদের দলীয় একটি চক্র এবং সমিতির জেলেরাও মাছ ধরার পক্ষে। চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় আমরা তাদের সাথে পেরে উঠতে পারিনি। এখানে মাছ চুরিতে বাঁধা দেয়ায় খোদ প্রহরীকে খুন হতে হয়েছে। এটি মা মাছ সংরক্ষণের একটি নিরাপদ আশ্রয় ছিল। কিন্তু তারা তা নষ্ট করে ফেলেছে।

নলকুরা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য সুরুত জামান জানান, ‘দিন রাতে স্থানীয় জেলে ও প্রভাবশালীরা এখানে মাছ চুরি করে। কখনো কারেন্ট জাল দিয়ে আবার কখনো বড়শি দিয়ে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যায়। আমরা বাঁধা দিতে গেলেই আমাদের উপর হুমকি আসে। মৎস্য অফিসে জানালে তারা মাছ চুরির সাথে জড়িতদেরকে ধরে নিয়ে যেতে বলে। এটা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব।’

তার মতো বেলাল হোসেন নামে আরেক জেলে জানান, ‘যারা মাছ ধরতে আসে তারা সমিতির নেতা বা উপরে বলেই আসে তাই আমরা নিষেধ করলে উল্টো আমাদেরকেই হুমকি দেয়।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘অভয়াশ্রমের বিষয়টি সমিতির সদস্যরা দেখভাল করে। মাঝে মাঝে অভিযোগ পেলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।’

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত