ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

অতিথি পাখি ছাড়াই জাবির পাখি মেলা

  জাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:০৫

অতিথি পাখি ছাড়াই জাবির পাখি মেলা

‘পাখ-পাখালি দেশের রত্ন, আসুন করি সবাই যত্ন’ এই প্রতিপাদ্য স্লোগানকে ধারণ করে শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৭তম পাখিমেলা। পাখি সংরক্ষণে গণসচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই ব্যতিক্রমধর্মী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেও ক্যাম্পাসে পাখিমেলার আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু পাখি মেলার আয়োজন যেই অতিথিদের নিয়ে তারাই আজ বিলুপ্তপ্রায়।

শীতের শুরুতেই হিমালয়ের উত্তরে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া আর তিব্বতের হিমশীতল এলাকা থেকে দলে দলে অতিথি পাখি আসা শুরু হয় বাংলাদেশে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে উষ্ণ আবহাওয়া থাকায় পাখিরা পাড়ি দেয় নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের এই দেশে। বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশও ভবঘুরে পাখিদের এমনই একটি গন্তব্য ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রতিবছর অক্টোবর থেকে পাখির পরিযান শুরু হয় সবুজে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন এই ক্যাম্পাসে। নভেম্বর আর ডিসেম্বরে অতিথি পাখির পরিযানের হার সবচেয়ে বেশি থাকে। জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিতে শীতের ছোঁয়া গায়ে লাগিয়ে আবারো ভবঘুরে অতিথি পাখিগুলো চলে যায় নিজ আবাসস্থলে। কিন্তু এবছর ফেব্রুয়ারি মাস আসার অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে কম অতিথি পাখির সংখ্যা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক, জাহানারা ইমাম, প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক, সুইমিং পুল সংলগ্ন লেকসহ কয়েকটি জলাশয় থেকে অতিথিরা চলে গেছে। কেন অতিথিরা সময়ের আগেই চলে গেছে এই বিষয়ে একাধিক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে তারা একরকম ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, দর্শনার্থীদের ভিড়, গাড়ির হর্ন, ছুটির দিনে ক্যাম্পাস পিকনিক স্পটে পরিণত, ঢাকঢোল বাজানো তদুপরি লেকের সুষ্ঠ সংরক্ষণের অভাবে অতিথিরা মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে।

প্রশাসনের উদাসীনতা ও খামখেয়ালীপনার কারণেও পাখিরা চলে গেছেন বলে অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন। অনেকে বলেন, সপ্তাহজুড়ে ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটে মানুষের কোলাহল, শাড়ি কাপড় বিক্রি, খেলনা, পিঠা কেনাকাটা , জন্মদিন পালনসহ ক্যাম্পাস রীতিমতো হাটে রূপ নেয়। অন্যদিকে ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। তাদের ব্যবহৃত খাবার মোড়ক, ঠোঙা ও পলিথিন জলাশয়ের পানিতে ফেলায় পরিযায়ী পাখির বিচরণের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ফলে পাখিরা তাদের অনুকূলে আবাসস্থল না পেয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছে।

শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসকিউ সেন্টারের লেক, শারীরিক শিক্ষা কার্যালয়সংলগ্ন জলাশয়ে কিছু পাখি থাকলেও অধিকাংশ লেক থেকে পাখি চলে গেছে বলে জানা যায়। বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পাসের ট্রান্সপোর্ট , টারজান্ট পয়েন্ট, বটতলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রসংলগ্ন অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এসব দোকানের ক্রেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলেও প্রধান ক্রেতা মূলত বহিরাগত দর্শনার্থীরা। প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে দুপুর রাত পর্যন্ত এসব দোকানে চলে কেনাকাটা । ফলে সপ্তাহজুড়ে এবং ছুটির দিনে ক্যাম্পাসে বিদ্যমান থাকে বহিরাগতদের উপচে পড়া ভিড়। দিনজুড়ে লোকসমাগম, হুই-হুল্লোর , গান বাজনায় পাখিরা বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, শুধু যে অতিথি পাখিরা চলে যাচ্ছে তা নয় অতিরিক্ত বহিরাগতদের আগমনে বিনষ্ট হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ, শিক্ষা-গবেষণা ও দৈনন্দিন জীবনেও ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক বহিরাগতের আনাগোনায় ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থারও ব্যঘাত ঘটেছে। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।

আইন ও বিচার বিভাগ বিভাগের শিক্ষার্থী শিহাব শাহরিয়ার বলেন, অতিথি পাখিরা নীরব শান্ত পরিবেশ ভালোবাসে। এদেশে অতিথিরা আসে একটু কম শীতে প্রাণ বাঁচাতে। তাদের দেখে আমরা মনকে আনন্দ দিই। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে তখন, যখন নিজের আনন্দের জন্য তাদের বিরক্ত করি। তাদের আবাসস্থলে যেয়ে হইচই করে, ঢিল ছুঁড়ে শান্তিময় পরিবেশ নষ্ট করে তাড়িয়ে দেই। আর সেই বিরক্তিকর কাজটি করছে ক্যাম্পাসে পাখি দেখতে আসা দর্শণার্থীরা।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে অতিথি পাখি চলে যাওয়া নিয়ে ক্যাম্পাসে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। যার প্রভাব দেখা গিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। “আমরাই জাহাঙ্গীরনগর” নামক একটি গ্রুপে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাবিব আহসান নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, অক্টোম্বরেও ক্যাম্পাসের লেকগুলো ছিল পাখিময়। আজ এই লেক পাখি শূন্য। মাস দুয়েক আগে যেখানে পাখি গুনে শেষ করা যাচ্ছিলো না সেইখানে আজ কোনো পাখিই নেই। এইভাবে চলতে থাকলে সামনের বছরগুলোতে আর হয়তো কোনো পাখিই আসবে না।

অন্য এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, এই পাখিমেলার আয়োজন যাদেরকে নিয়ে তারাই আজ বিলুপ্তপ্রায়। ক্যাম্পাসে যে হারে বহিরাগতরা আসছে এবং শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে এতে পাখি কেন কয়েকদিন পর শিক্ষার্থীরাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

পাখিমেলার উপজীব্য বিষয় কি হওয়া উচিত জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের খালিদ হাসান বলেন, এবছর পাখিমেলার মূল আলোচ্য বিষয় হোক পাখির বসবাসের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা। পাখিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পাখি চলে যাওয়ার সমস্যাগুলো চিহিৃত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক। সবার স্বদিচ্ছা থাকলে এই অতিথিদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তা না হলে কয়েকবছর পর পাখি থাকবে না পড়ে থাকবে পাখিশূন্য এই লেক।

চলমান এ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছেন তারা। শিক্ষকদের মতে, অগণিত দর্শনার্থীর সমাগম ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। সবাইকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। তবে প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকেই।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শীত মৌসুমে অক্টোবর-নভেম্বরে সাইবেরিয়া, চীন,মঙ্গোলিয়া আর হিমালয়ের উত্তর থেকে অতিথি পাখিগুলো আসে ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে। থাকে প্রায় ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত। গড়ে ৬০ প্রজাতির পাখি দেখা যায় জলাশয়গুলোতে। যার অধিকাংশই পাতি সরালি। আর কিছু আছে রাজ সরালি। এ ছাড়া লেঞ্জা, বালি, ভূতি, গার্গেনি, খঞ্জনা অন্যতম।

পাখি বিলুপ্তির বিষয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, তাপমাত্রা, জলবায়ুর তারতম্য হয়েছে। সে জন্য পাখি অন্যত্র যেতে পারে। এদিকে গত কয়েকদিন ধরে পাখি নেই কয়েকটি জলাশয়ে। ছুটির দিনগুলোতে যে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত দর্শনার্থী গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন, তাতে এ ক্যাম্পাসে পাখিদের জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে না। গাড়ির হর্ণ এবং কোলাহলের কারণেই লেকগুলো থেকে পরিযায়ী পাখি চলে গেছে।

তিনি আরও বলেন, পাখি আসার পর জলাশয়ের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের অভাবও অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া জলাশয়ে বাড়ছে কচুরিপানা, সাথে সাথে পাখিদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা। নেই কোন পর্যবেক্ষণ, সংরক্ষণ বা পাখি বসার পালং। জলাশয়ের আশেপাশে জঙ্গল কেটে ফেলায় বাসস্থান সংকটও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ক্যাম্পাস থেকে এভাবে অতিথি পাখির চলে যাওয়া আমরা মানতে পারছি না। ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রশাসন সদা তৎপর। ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুষ্ঠ রাখতে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যতদ্রুত সম্ভব অতিথি পাখিদের আবাসস্থল পরিস্কার, খাবার এবং তাদের সঠিক নিরাপত্তা প্রদান ও সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। অতিদ্রুত অতিথি পাখিদের পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যাম্পাস এলাকাকে নিরাপদ অভয়ারণ্য করতে চেষ্টা করব।’

  • সর্বশেষ
  • পঠিত