ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

কঠিন নীতিমালার বেড়াজালে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

কঠিন নীতিমালার বেড়াজালে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

নতুন এমপিওভুক্তি পেতে নীতিমালার কঠিন বেড়াজালে পড়তে হচ্ছে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। সদ্য জারি হওয়া এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, এমপিওভুক্তি পেতে প্রথমে আবেদন করতে হবে। এরপর তথ্য যাচাই-বাছাই করে এমপিও দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদনের শর্ত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সময়, শিক্ষার্থী সংখ্যা, পরীক্ষার্থী সংখ্যা ও উত্তীর্ণের সংখ্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এসব শর্ত মানতে হলে এক শর বেশি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন করারই যোগ্যতা নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ কৌশল গ্রহণ করেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এর জন্য বরাদ্দও নেই। এরপর শিক্ষকরা আন্দোলনে নামলে গত ১৪ জুন ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়। এ অবস্থায় নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমপিও পেতে হলে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এই নীতিমালার শর্ত মেনে এমপিওর আবেদন করতে পারবে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শখানেক। নীতিমালা জারির পর বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা সম্ভব, আগে শর্ত পূরণ কর, তারপর এমপিও নাও।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের কথায়ও এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি ঈদ-পরবর্তী প্রথম কর্মদিবসে গত সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাজেটে সব বিষয় উল্লেখ থাকে না। আবার একসঙ্গে সব প্রতিষ্ঠান এমপিও করাও সম্ভব নয়। এ জন্যই শর্তসাপেক্ষে এমপিও দিতে এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে প্রথমে আবেদন গ্রহণ করা হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে এমপিওভুক্ত করা হবে। এমপিওভুক্তির আওতায় আসতে হলে নীতিমালার শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।’

জানা যায়, বর্তমানে সরকার স্বীকৃত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা পাঁচ হাজার ২৪২টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০ হাজারের ওপর শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি করছেন। দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা বিনা বেতনে চাকরি করছেন, সব শেষ ২০১০ সালে সরকার এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। এরপর থেকে এমপিওভুক্তি বন্ধ রয়েছে।

তবে নতুন এমপিওভুক্তি নিয়ে সরকারের মধ্যেও ধোঁয়াশা কাজ করছে। গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আরো এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিওভুক্ত করা হবে। এ জন্য বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে যেসব স্কুল এমপিওভুক্ত নয় এমন স্কুলের উপকরণ, ভবনসহ বিভিন্ন খাতেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এমপিও একটি নিরর্থক কর্মসূচি। এটি শিক্ষকদের খুশি করার জন্য দেওয়া হয়। স্কুলের উপকার হয় না।’

নন-এমপিও শিক্ষকরা আন্দোলনে নামার পর ঈদের আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে বলেছিলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাজেটে অনেক বিষয়ে উল্লেখ করে দেওয়া নেই। এটা জরুরি বিষয়ও নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে এমপিওভুক্ত করা হবে।’ তবে কতগুলো প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

আবার গত সোমবার সরকারের একজন মন্ত্রী জাতীয় সংসদ ভবনে আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর আলোচনায় বলেন, ‘এমপিওভুক্তির কথা বলা হলেও বাজেটে কাগজে-কলমে কিছু দেখছি না। আল্লাহর ওয়াস্তে এমপিওভুক্তি করে দেন, না হলে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে চালু রাখারও অনুরোধ জানান তিনি।

এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি পেতে প্রধান চারটি শর্ত রাখা হয়েছে। এগুলোর জন্য রাখা হয়েছে ১০০ নম্বর। এতে একাডেমিক স্বীকৃতির তারিখের জন্য রাখা হয়েছে ২৫ নম্বর। প্রতি দুই বছরের জন্য ৫ নম্বর এবং ১০ বা এর চেয়ে বেশি বছর হলে পাবে ২৫ নম্বর। শিক্ষার্থীসংখ্যার জন্য ২৫ নম্বর। আর শিক্ষার্থীর কাম্য সংখ্যা থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান পাবে ১৫ নম্বর এবং এর পরবর্তী ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য পাবে ৫ নম্বর। পরীক্ষার্থী এবং উত্তীর্ণের সংখ্যায়ও শিক্ষার্থীসংখ্যার মতোই একইভাবে নম্বর বণ্টন করা হয়েছে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি পেতে কাম্য শর্তাদি অবশ্যই পূরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি থাকবে, যারা বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ওই কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। সরকার এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণসাপেক্ষে আদেশ দিবে।

কাম্য যোগ্যতা পূরণ করতে নীতিমালা অনুযায়ী, সহশিক্ষা ও বালক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। মাধ্যমিকে শহরে ৩০০ ও মফস্বলে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। স্কুল অ্যান্ড কলেজে শহরে ৪৫০ ও মফস্বলে ৩২০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। স্নাতক পাস কলেজে শহরে ২৫০ ও মফস্বলে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। আর প্রতিটি শ্রেণির পরীক্ষায় শহরে ৬০ ও মফস্বলে ৪০ জন শিক্ষার্থীর অংশ নিতে হবে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ হতে হবে।

বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ১৮ থেকে ২০ বছরের পুরনো। আমাদের তো অনেক আগেই এমপিও পাওয়ার কথা ছিল। আমাদের জন্য এই নীতিমালা কার্যকর করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এমপিও হলে এক শর বেশি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ করতে পারবে না।’

উদাহরণ হিসেবে এই শিক্ষক নেতা বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান খুলনা আইডিয়াল কলেজ ২০০৬ সালে বোর্ডের মধ্যে অষ্টম স্থান লাভ করেছিল। আর এখন আমাদের দুটি জিপিএ ৫ পেতেই কষ্ট হয়। আবার খুলনারই রূপসা মহিলা কলেজে শিক্ষার্থী ছিল না বললেই চলে। অথচ তারা এমপিও পাওয়ার পর এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আর্থিক সংস্থান না থাকলে প্রতিষ্ঠান চালানো খুবই কষ্টকর।’

মাউশি অধিদপ্তরের এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) সেলের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জানা যায়, দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। সবচেয়ে বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এরপর রংপুর ও খুলনা বিভাগে। এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে দুই হাজার ৭০১টি, চট্টগ্রামে দুই হাজার ১৫টি, কুমিল্লায় এক হাজার ৯৮৪টি, ঢাকায় তিন হাজার ২৭টি, খুলনায় তিন হাজার ৫৭৯টি, ময়মনসিংহে তিন হাজার ৫৭টি, রাজশাহীতে চার হাজার ১০৮টি, রংপুরে তিন হাজার ৯৯৭টি এবং সিলেট বিভাগে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এক হাজার ৮৯টি। যেসব এলাকায় কম প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব এলাকা নতুন এমপিওভুক্তি পেতে অগ্রাধিকার পাবে বলেও জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসের পরও শিক্ষকরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বাজেটে ঘোষণা না আসায় গত ১০ জুন থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। এমনকি ঈদের দিনও তাঁরা ছিলেন রাজপথে। গতকাল মঙ্গলবারও শিক্ষকরা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে আজ বুধবার বিকেলে ফেডারেশনের সভা রয়েছে। সেখান থেকে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আমরণ অনশনসহ আরো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

সংগঠনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘আমাদের এবার ২৮তম কর্মসূচি। আগের ২৬ বার শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তিনি তখন বলেছিলেন, বাজেটে বরাদ্দ না থাকায় এমপিও দিতে পারছি না। আর এখন তিনিই বলছেন, বাজেটে বরাদ্দ না থাকলেও এমপিওভুক্তি করা হবে। তাই তাঁর কথায় আমাদের আর আস্থা নেই। ২৭তম কর্মসূচির সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা এসে আমাদের অনশন ভাঙিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যখন আশ্বাস এসেছিল, আমরা এখন তাঁর মুখ থেকেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন চাই।’

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ) শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নির্দেশিকা শীর্ষক নীতিমালা প্রথমে ১৯৯৫ সালে প্রণীত হয়। ২০১০ ও ২০১৩ সালে এটি দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। আর গত ১৪ জুন জারি হয়েছে এমপিও নীতিমালা-২০১৮।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত