ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

গার্মেন্টসকর্মী থেকে যেভাবে বিসিএস ক্যাডার হলেন সবুজ

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০০  
আপডেট :
 ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:২৪

গার্মেন্টসকর্মী থেকে যেভাবে বিসিএস ক্যাডার হলেন সবুজ
সবুজ আহম্মেদ

ঠাকুরগাঁওয়ের ছেলে সবুজ আহম্মেদ ২০০৮ সালে রাণীশনকৈল ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করার সুযোগ হয়নি। এমনকি শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হলো না।

সহপাঠী ও বন্ধুদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে তখন। এসব দেখে সবুজ প্রচণ্ড হতাশ হলেন। পরে ঢাকায় এসে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় তামিশনা ফ্যাশন নামের একটি সোয়েটার গার্মেন্টসে চাকরি নিলেন। বেতন মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা। টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকায় ফ্যাক্টরি, আর কাছেই এক টিনের ঘরে থাকার ব্যবস্থা হলো। একরুমে গাদাগাদি করে ৬ জন। এভাবেই প্রায় দশমাস কেটে গেল। একদিন তিনি তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলে জানতে পারেন, সেই বন্ধুটির আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমানো টাকা নিয়ে ওই বন্ধুর কাছে চলে গেলেন সবুজ। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে ভর্তির ফরম জমা দিলেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাত্র সতেরো দিন আগে প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষা দিয়ে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে হলেন ১৩তম। পছন্দের বিষয় বাংলায় ভর্তি হয়েই শুরু করলেন টিউশনি। প্রায় দেড় বছর পর প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে প্রথম পাঁচজনের একজন হলেন। বিভাগীয় প্রধান ড. আমির আলী আজাদের সহযোগিতায় এক্সিম ব্যাংকের স্কলারশিপ পেলেন এবং ড. আমিরের পরামর্শেই টিসি নিয়ে চলে গেলেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতি চলছিল। অনার্স শেষ করে ঢাকা কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হলেন। এর কয়েকমাস পরেই ৩৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশ নিলেন।

মাঝে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি হলো তার। এরমধ্যে ক্যাডেট কলেজের লেকচারার হিসেবে যোগদানের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। প্রথম শ্রেণির পদ হওয়ায় বিমান ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে যোগ দিলেন। সিলেট ক্যাডেট কলেজের বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন, পাশাপাশি পড়াশোনা চলছিল।

পর্যায়ক্রমে বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা, এমএ পরীক্ষা দিলেন। ডাক এলো বিসিএসের ভাইভার। গত ১২ জুন ৩৭তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয়, সবুজ এতে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, অর্জন করেছেন ষষ্ঠ স্থান।

সবুজ বললেন, ‘অনেক সমস্যা পার করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছি। পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে।’

ফারজানার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প: নৌবাহিনী কর্মকর্তা বাবার হাত ধরে ১৯৯৫ সালে প্রথম স্কুলে যান উম্মে হাবিবা ফারজানা। ভর্তি হন চট্টগ্রামের বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজে। সেখান থেকে বেরিয়েছেন ১২ বছর পর, ২০০৭ সালে। তবে তার এই এক যুগের শিক্ষা জীবনে শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন তার বাবা। পড়াশোনা আর জানার প্রতি আগ্রহ তৈরিতে বাবার অবদান বেশি। এটিই ছিল ফারজানার সাফল্যের মূলমন্ত্র, যে কারণে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও তিনি ৩৭তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

এস এম মাহবুবুর রহমান ও বিলকিস খানম দম্পতির বড় সন্তান ফারজানা। বরিশালের পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়ি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।

পরিবারের স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর ফারজানা তেমন পড়াশোনাই করেননি। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। যেহেতু সাধারণ জ্ঞান ও বাংলা-ইংরেজি ভালোই পারতেন, তাই সুযোগ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় মাত্র ১৯ বছর বয়সেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেল। শুরুতে এ নিয়ে অনেকরকম জল্পনা-কল্পনা থাকলেও বাস্তবে সংসার সামলানোর পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন—এটা উপলব্ধি করলেন।

মাঝে মাঝে বিষণ্নতা অনুভব করলেও তা কাটিয়ে উঠে নিজেই নিজেকে অনুপ্রেরণা দিতেন। মাস্টার্স ফাইনালের সময় সন্তান গর্ভে। আসল সংগ্রাম শুরু হলো তখন থেকে। পারিবারিক ব্যস্ততায় মাও সময় দিতে পারেননি। পুরোটা সময় নিজেই নিজেকে সামলেছেন। মেয়ের জন্মের পর দু’বছর পোস্ট-ন্যাটাল ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, তবে এর প্রভাব মেয়ের ওপর পড়তে দেননি। এভাবেই চার বছর কাটল, মেয়ে কিছুটা বড় হলো। এই চার বছরে ফারজানা কোনো পড়াশোনা করেননি। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু সংগ্রাম করে বিসিএস ক্যাডার হওয়া অন্যদের গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের মনে শক্তি সঞ্চার করলেন। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলেন। সারাদিন বিরামহীনভাবে সংসার সামলে বই ধরার ফুসরত মিলত যখন, তখন অন্যরা ঘুমের রাজ্যে।

ফারজানা ভাবলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের করের টাকায় পড়াশোনা করে তিনি ঋণী হয়েছেন, সেই ঋণ তাকে শোধ করতে হবে। সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আছে। ৩৭তম বিসিএসে আবেদন করার পর যখন প্রিলিমিনারির প্রস্তুতি শুরু করলেন, তখন পরীক্ষার মাত্র ২ মাস বাকি। পরীক্ষার আগে হঠাৎ জলবসন্ত হল, এ অবস্থাতেই পরীক্ষা দিলেন। উত্তীর্ণ হলেন এই ধাপে। পরে দেড়মাস দিনরাত পড়াশোনা করে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এসময় তার স্বামী, মা ও বোন সহযোগিতা করেছেন। এই ধাপেও উত্তীর্ণ হলেন ফারজানা। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে পড়তে বসতেন। এভাবেই পরিক্ষার ভাইভা’র সময় এসে গেল। অবশেষে ফলাফল প্রকাশের পর ফারজানা দেখলেন তিনি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এটি যে তার প্রথম বিসিএস ছিল তাই নয়, এটি ছিল প্রথম চাকরির পরীক্ষাও!

ফারজানা বললেন, ‘আমি নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছি। শুরুতে আমাকে নিয়ে কেউ তেমন আশাবাদী ছিলেন না। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর আমার বাবা-মা, স্বামী, শ্বশুরসহ সবাই সহযোগিতা করেছেন, উত্সাহ দিয়েছেন, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

তিনি বলেন, ‘সফলতার জন্য নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। আমি মানুষ, আমি একটা আলাদা সত্ত্বা। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর এজন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো পরিশ্রম। সে বিষয়ে কখনোই পিছপা হওয়া যাবে না।’

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ফারজানা বলেন, ‘থেমে গেলে চলবে না। ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে। যে সময়টা পাওয়া যায় তার পুরোটা সঠিক ব্যবহার করতে হবে। কাজে লাগাতে হবে। আর পড়াশোনা চলাকালে সব রকম ডিভাইস থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে যতটুকু সময় পড়ার, সে সময়টা পুরোপুরি পড়লে সফলতা আসবেই।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত