ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘দেবী’ দর্শন: ভূতের পাল্লায় সময়ক্ষেপণ!

  পলিয়ার ওয়াহিদ

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৩০

‘দেবী’ দর্শন: ভূতের পাল্লায় সময়ক্ষেপণ!

হঠাৎ করেই মাথায় কেড়া ঢুকলো। প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক শাহনেওয়াজ সুমন আর কন্ঠকর্মী তরিকুল ফাহিদসহ ‘দেবী’ দর্শনে যাওয়ার কথাও হল পাকাপাকি। কিন্তু শব্দ আর জ্যামের শহরে তরুণরা রাতের কথা সকালে ভুলে যাচ্ছেন! কাউকে আর সকালে ফোনে পাওয়া যায়নি। আগের দিনের দর্শকদের লোভনীয় সব ডায়লগে মন টলটল করছিল। কপালে যেহেতু দুটো জ্যন্ত চোখ বসে আছে, তাদের একটু বেগার খাটালে দোষ কী! নরম জিব্বা থাকতে কেন অন্যের মুখে ঝাল নিতে রাজি হবো? অগত্যা তাই নকিব আর সূরাইয়াকে নিয়ে রওনা হলাম ‘মধুমিতা’র অন্দরমহলে। মধুমিতার প্রতি আমার একটা দুর্লভ আর্কষণের কারণে ফার্মগেট থেকে শাপলা চত্ত্বর যেতেই জ্যামে বসে সময়ের বারোটা বেজে গেল! দ্রুত টিকিট কেটে সাড়ে বারোর শো ধরা। ‘দেবী’র সাথে সেলফি আর সূরাইয়ার সাথে চিপসে মজেই উঠলো ‘দেবী’র আলাপন। কেমন হবে এই উত্তেজনায় আমি প্রায় মূর্ছিত!

ক্যাচ-কুচ করে একটা শব্দ। খুলে গেল হলের সদরদরজা। ভেতর অন্ধকার। শতশত চেয়ারে ভূতের মতো বসে আছে মাথা! পর্দায় ভেসে উঠলো রামদা! একটা শরীর থেকে মাথা আলাদা করার দৃশ্য! প্রথমেই ভড়কে গেলাম। পর্দায় আরো ভেসে উঠলো ১৭৫৭! কেন এই সময়টাকে এখানে ব্যবহার করা হলো তা শেষ পর্যন্ত ঠিক মতো বুঝিনি। নাকি নবাবের সাথে মীর জাফরের সেই প্রতারণার বিষ আজো আমাদের রাজনীতির রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে গেছে বলেই! কিন্তু একটু পরেই ‘২০১৮ ঢাকা’ লেখা দেখে চট করে বর্তমানে ফিরে আসি।

পরে দেখা গেছে সেটা একটা পুরাতন বিষ্ণু মন্দির। সেখানে একটা দেবীর মূর্তি দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত এই মূর্তিটাকে ঘিরে আবর্তিত হয় মূল কাহিনি। খুবই রহস্যময় ঘটনা হল, পুরো সিনেমাটাই একেবারে খাপছাড়া। টোটালিটি বলে কিছু নেই। যেহেতু উপন্যাস থেকে সিনেমা সেহেতু কাহিনির বুনন খুব সহজ নয়। ফলে মূল কাহিনিকে তারা যেন বাদ দিয়ে ছায়ার পিছনে ঘুরেছেন!

আশার বিষয় হলো, যুক্তি-প্রযুক্তির ব্যাখ্যার বাইরেও যে একটা মস্তবড় পৃথিবী আমাদের চালিত করে সেটার একটা আবহ দেখানোর চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে প্রচলিত লৌকিক আচারের দিকে দর্শকের মুখ যেন বার বার ফিরেয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ভূতের থাকা না- থাকার বিস্তর অনুসন্ধানের পিছু নেওয়া মাস্টার মশাই (যাকে মিসির আলী বলে) তিনি সবাইকে মোহিত করেন।

বকরবকর না করে মূলকাহিনিটা বলে ফেলাই ভালো। রানু (জয়া) স্বামী আনিস আহমেদ (অনিমেষ আইচ)-এর সাথে বিবাহের পর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ করে। স্বামী হিসেবে বেচারা দারুণ ঝামেলায় পড়ে যায়। সে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নেয় কীভাবে কাকে ধরে স্ত্রীর এই সমস্যার সমাধান করবে। ফলে সে একদিন বিশ্ববিদ্যায়ের এক টিচারের (চঞ্চল) খবর পান। যিনি নিজেকে লুকানোর চরিত্রে বড্ড পাকা। সাদা চুলের সেই মাষ্টার মশাই সত্যি দারুণ সব যুক্তি আর অভিজ্ঞতায় সত্য আবিস্কারে নেমে পড়েন। রানুকে নিয়ে আসার হুকুম করেন তিনি। রোগী ছাড়া চিকিৎসা কীভাবে সম্ভব? রানুকে আনার পর তিনি রানুর কাছে তার স্ববিস্তার জানতে চান। রানু বলতে বলতে শৈশবে তার এক বোনের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে কাদা ও রঙ খেলার পর নদীতে গোসল করতে যাওয়া, গোসল করতে গেলে জালালউদ্দিন বিশ্বাস নামে এক লোক নাকি তার পাজামা খুলে নেয়। পরে জানা যায় জালালউদ্দিন আগেই মারা গেছেন। তার লাশ তার পায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। আরো পরে আবিস্কৃত হয় রানুর যে ভাঙা মন্দিরে প্রতিদিন যেত। সেখানে তার উপর কেউ একজন যৌননির্যাতন চালাতে চেষ্টা করে। সেই তার পাজামা খুলে ফেলে। এবং তাকে জড়িয়ে ধরার পর সেই লোকটির দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। তার মানে ধারণা করা হয় সেই মূর্তি (দেবী)ই রানুর ভেতরে ঢুকে পড়ে! এবং তারপর থেকেই সে নিকট ভবিষ্যত বলে দিতে পারত। এইটুকু দারুণ।

রানুর উপর সেই (দেবী) তার অতীত কল্পনা বার বার হানা দেয়। রাতে-দিনে তার পাগলামী বাড়ে। তাকে কে যেন নাম ধরে ডাকে। তাকে কাছে আসতে বলে। বিকট শব্দ বা গন্ধ পায় তখন রানু। আস্তে আস্তে আনিসকেও ভয় দিতে থাকে। আনিস-রানু দম্পত্তির কোনো ছেলে-মেয়ে না থাকায় তারা জিতু মিয়া নামে যে ছেলেটাকে বাড়িতে রাখে সেও একদিন ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে প্রসাব করে যেই না সিঁড়িতে নামে ওমনি সেই ছায়া (যাকে ভূত বলা হচ্ছে) তাকে দেখে। এইভাবে রানু, আনিস, জিতুকেও ভয় দেখাতে সামর্থ্য হয়।

মাষ্টার মশাই (চঞ্চল) রানুর গ্রামের বাড়িতে চলে যান সঠিক খবর নিতে। কারণ তিনি ভূত বিশ্বাস করেন না। কার্যকারণ আবিস্কারে অদম্য চেষ্টাটুকুই কেবল সিনেমার কাহিনি বলেই মনে হয়। জয়া যে অস্বাভাবিক আচরণের অভিনয় করেন সেটাও দারুণ। চঞ্চল দ্যা গ্রেট। অভিনয় নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। দুজনই নামকরা অভিনেতা তাদের অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো ফাঁকফোঁকর নেই। শুধু সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর মনে হয়েছে কিছুই যেন হলো না! শেষ নেই শুরু নেই কেমন যেন বেখাপ্পা লেগেছে। একেবারে হতাশ হয়েছি! সিনেমা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অনেকে দুহাত উপরে তুলে আসলেমী ভাঙতে ভাঙতে বলছে-ধুর! ভূতের ছবি দেখে সময় নষ্ট হল। আমি অবশ্য দুজন রমণী দর্শকের মুখোমুখি হলে তারা আমতা আমতা করে বলল- কি দেখলাম কেমন জানি কুয়াশার মতো ঠেকেছে! বুঝতে পারিনি ফলে বোঝাতে না পারারই কথা।

অনেকে বলছেন কি বোঝাতে চেয়েছেন এই সিনেমায়? যদি ভূত না-থাকার কথাই বলা হবে তাহলে তার ভবিষ্যত বানীগুলো যে সত্য হচ্ছিল সেটা দেখে যুক্তিবাদী (মাষ্টার মিসির) চঞ্চলও ভড়কে গেছেন। ভূত থাকা না-থাকর সে দ্বন্দ্ব সেটাই সর্বশেষ ম্যাসেজ হলেও তা পুরোপুরি আড়াল করা হয়েছে। ইচ্ছা করলে দর্শককে আরো একটু পরিস্কার করা যেত। তাহলে সবাই আশান্বিত হতো।

নিলু (শবনম ফারিয়া) একেবারে বাজে অভিনয় করছে। তার অভিনয় বোঝাই যায় যে সে অভিয়ন করছে। ইরেশ আর ফারিয়ার দেখা হওয়া কফিশফটা সিনেমার সাথে একেবারে নামায় না। এটা একটা খোলা জায়গায় বা কোনো পার্কে হলেও মন্দ হতো না। আর কোনো কারণ ছাড়াই ফেসবুকে পরিচিত একটি ছেলের সাথে বর্তমানে এমন ঘটনাকে দেখানের ব্যাপারটা আরো অবিশ্বাস তৈরি করে দর্শক মনে। ফলে ভালোবাসার জায়গাগুলো আরো দূরত্বে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। কেমন যেন সব বেখাপ্পা লাগে। এমন ঘটনা যদিও অহরহ ঘটছে। ফলে মানুষকে আরো অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে না দিয়ে একটা বিশ্বাসের বা স্বপ্নের জায়গা তৈরি করাই তো সিনোমা-নাটক, গান-কবিতার কাজ। সবাই যদি অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে সবাই মিলেই কি বিশ্বাসের গলা টিপে ধরছি না?

শেষে চঞ্চল, জয়া, অনিমেষের অভিনয় নিয়ে প্রসংশা করতে চাই। চঞ্জল আর জয়ার আড়ালে যেন আইচ আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন। তবে লোকেশন, সাউণ্ড দিয়ে ইমেজ ধরার চেষ্টাসহ কয়েকটা জায়গায় ভালো লেগেছে। ভয়ের বা ভূতের সিনগুলো দ্রুত টার্ন করাও ছিল বুদ্ধিমত্তার। রানুর ছোটবেলার কার চরিত্রে যে মেয়েটা অভিনয় করেছে সেও ভালো অভিনয় করেছে অল্পসময়ে। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখা গেলেও দর্শক তাকে মনে রেখেছে। কারণ সেই ছোট্ট রানুর মুখের যে যাবতীয় লাবণ্যের স্মৃতি। প্রিয় দর্শক ভালো না লাগা শেয়ার করার জন্য বিনীত ক্ষমা চাচ্ছি। আমার অনুভূতিটুকু আমি শেয়ার করলাম মাত্র। যেমনটা আমার মনে হয়েছে ঠিক তেমনটা।

সিনেমার মূল যে কাহিনি (অতীত জীবনের মূল বিষয়টাও পরিষ্কার করা হয়নি। কারণ জানতে জানতেই সিনেমা শেষ হয়ে যায়। কে যে রানুর পাজামা খুলে ফেলে বা জালালউদ্দিন বিশ্বাস নামে আদৌ কেউ ছিল না কিনা সেটাও পরিস্কার করা হয়নি। এবং রানুর সবকিছু কল্পনাই ছিল কিনা সেটাও পরিস্কার করা হয়নি। বাঙালি দর্শক নিয়ে যে হুজুগে ব্যাপার নেই সেটা কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। ফলে সবাই চঞ্চল আর জয়ার অভিনয় দেখেই ফিদা। আসলে আমি অভিনয়টাকে সিনেমায় গুরুত্ব দিচ্ছি না। কাহিনির ভেতর দর্শক কতটা ঢুকতে পারলো এবং বুঝতে পারলো সেটাও গুরুত্ত্বপূর্ণ। ভালো শিল্পীরা ভালো অভিনয় করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমি আগেও বলেছি। ফলে দর্শক কি পেলেন সেটাই আমার আলোচনার মূল বিষয়। কি পেলেন আপনি? সেটাও কি বিবেচ্য নয়? নাকি আপনি এখনো সস্তা সময়ের গায়ে ফোঁড়নকাটা ভেজাল তেল? ফুঁসে উঠতেও ভুলে গেছেন?

লেখক: কবি ও গদ্যকার

বাংলাদেশ জার্নাল/কেআই/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত