ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

আনন্দের জন্য যৌনমিলনের বিরোধী ছিলেন গান্ধী

আনন্দের জন্য যৌনমিলনের বিরোধী ছিলেন গান্ধী

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চাইতেন কেবল আনন্দের জন্য যৌনতাকে নারীরা যেন প্রতিরোধ করে। তিনি চাইতেন, কেবল সন্তান উৎপাদনের জন্য যেটুকু দরকার যেন সেটুকু যৌনসম্পর্ক করেন নারী-পুরুষেরা।

মার্কিন জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে ১৯৩৫ সালে গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল, সম্প্রতি তার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। ওই কথোপকথন থেকেই এসব জানা গেছে।

সম্প্রতি ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের লেখা গান্ধীর এক নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ বইতে নারী অধিকার, যৌনতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা উঠে এসেছে। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট নিয়েছিলেন গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই।

তিনি লিখছেন: ‘মনে হচ্ছিল দু'জনেই একমত যে নারীর মুক্তি হওয়া উচিৎ - তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া উচিৎ’ । কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা গেল।

মার্গারেট স্যাঙ্গার ১৯১৬ সালের নিউ ইয়র্কে খুলেছিলেন আমেরিকার প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। তিনি মনে করতেন, জন্মনিরোধকই হচ্ছে নারীর মুক্তির সবচেয়ে নিরাপদ পথ।

কিন্তু গান্ধী বললেন, পুরুষদের উচিৎ তাদের 'যৌন কামনা'কে সংযত করা। আর নারীদের উচিৎ তাদের স্বামীদের বাধা দেয়া। তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন, যৌনক্রিয়া করা উচিৎ শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই।

ওই বছর ভারতের ১৮টি শহরে সফর করেছিলেন স্যাঙ্গার। কথা বলেছিলেন ডাক্তার ও কর্মীদের সাথে। তাদের কথাবার্তার বিষয়বস্তু ছিল - জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং নারীমুক্তি। তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্যে গান্ধীর আশ্রমেও গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তার সাথে স্যাঙ্গারের এই কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা হয়।

তবে গান্ধীর মতামত শুনেও মিসেস স্যাঙ্গার দমে গেলেন না। তিনি বিতর্ক চালিয়ে গেলেন।

স্যাঙ্গার তখন বলেন, ‘কিন্তু নারীরও তো গভীর যৌন অনুভুতি আছে, তারা পুরুষের মতোই গভীর এবং তীব্র। এমন সময় আছে যখন নারীরাও ঠিক তাদের স্বামীদের মতোই শারীরিক মিলন চায়।’

‘আপনি কি মনে করেন যে যখন একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ এবং সুখী, তখন তারা শুধু বছরে দু'একবার যখন সন্তান চাইবে তখনই যৌনমিলন করবে - এটা কি সম্ভব?’ প্রশ্ন করলেন মিসেস স্যাঙ্গার।

নিজের মন্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিলেন মার্গারেট স্যাঙ্গার। তিনি গান্ধীকে বললেন, ‘ঠিক এজন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ খুবই সুবিধাজনক, যা নারীকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার দেহের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।’

কিন্তু গান্ধী একগুঁয়েভাবে তার বিরোধিতা করতে থাকলেন। তিনি স্যাঙ্গারকে বললেন, তিনি সব যৌনতাকেই ‘কামনা’ বলে মনে করেন।

গান্ধী বলেন, তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক তখনই ‘আধ্যাত্মিক’হয়ে উঠেছিল যখন তিনি 'শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন।

এগারোশ' উনত্রিশ পাতার এই বইয়ে শান্তিবাদী নেতা গান্ধীর ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাথে তার নিহত হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে।

গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়েসে। এরপর ৩৮ বছর বয়েসে - যখন তিনি চার সন্তানের পিতা - তখন তিনি ‘ব্রহ্মচর্য’ বা যৌন সম্পর্ক বিহীন জীবনযাপন শুরু করেন।

গান্ধী নিজেই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা যখন মারা যান তখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করছিলেন বলে পিতার পাশে থাকতে পারেন নি। এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছিল।

অবশ্য, মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে কথাবার্তার শেষ দিকে গান্ধী তার সাথে কিছুটা একমত হলেন।

তিনি বললেন, পুরুষের স্বেচ্ছামূলক বন্ধ্যাকরণে তার আপত্তি নেই, কারণ পুরুষই মুখ্য ভুমিকা নেয়। তা ছাড়া গর্ভনিরোধক ব্যবহারের চাইতে প্রতিমাসে নারীর যে ‘নিরাপদ সময়’ থাকে তখন স্বামী-স্ত্রী যৌনমিলন করতে পারে।

মার্গারেট স্যাঙ্গার

গান্ধীর এসব যুক্তি স্যাঙ্গারের পছন্দ হয়নি। তার ভাবনাকে গান্ধী যে স্বীকৃতি দিলেন না এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। এ নিয়ে পরে তিনি লিখেছিলেন, প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অবাধ যৌনাচার সম্পর্কে গান্ধীর প্রচণ্ড ভীতি আছে।

এবারই প্রথম নয়, গান্ধী বরাবরই জন্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে বলেছিলেন: ‘আপনি কি মনে করেন যে জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব? নারীদের বরং শেখা উচিৎ কিভাবে তাদের স্বামীদের ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, নারী আর পুরুষ বাঁচবে শুধু যৌনতার জন্য, তাদের মস্তিষ্ক হবে দুর্বল। নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।’

‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের বইটিতে রামচন্দ্র গুহ বলছেন, গান্ধী মনে করতেন যৌনতা হচ্ছে ‘জান্তব কামনা’ মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।

এর অনেক বছর পর বঙ্গ প্রদেশের নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যখন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে, তখন গান্ধী এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি তার নাতনী এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে বললেন, তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে।

তিনি নিজের যৌন আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা, সেটি পরীক্ষা করার জন্যই তিনি এমনটি বলেছিলেন।

রামচন্দ্র গুহ লিখছেন, গান্ধী মনে করতেন, তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে।

তবে মানু গান্ধীকে নিয়ে ঘুমানোর পরীক্ষার কথা যখন গান্ধী তার সহযোগীদের বললেন, তখন তারা তাকে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যেন এটা আর না করেন। এতে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।

একজন সহকারী বলেছিলেন, এটা দুর্বোধ্য এবং সমর্থনের অযোগ্য। এর প্রতিবাদে তখন এক সহযোগী গান্ধীর সাথে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই নারীদের সাথে গান্ধীর সম্পর্ক ছিল জটিল।

যে নারীরা পুরুষদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। ‘আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তার ছিল তীব্র ঘৃণা।’ তিনি মুসলিম নারীদের বোরকারও বিরোধী ছিলেন। এ নিয়ে মানু গান্ধীকে তিনি লিখেছিলেন।

তবে তিনি নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যের সমর্থক ছিলেন। তিনি নারীদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। সরোজিনী নাইডুকে কংগ্রেসের নেত্রী বানিয়েছিলেন - যখন পশ্চিমা দেশেও নারী রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন খুবই কম।

তবে গান্ধী এটাও বিশ্বাস করতেন, সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্মই নারীদের আসল কাজ।

তার একজন সহযোগী বলেছিলেন, তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রীষ্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মত।

ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।

রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, আজকের মাপকাঠিতে বিচার করলে গান্ধীকে রক্ষণশীল বলা যায়, তবে তার নিজ সময়ের বিচারে তিনি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন।

গান্ধীর সাথে তার দুই নাতনী মানু (ডানে) ও আভা

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত