ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের দিকে সুনজর দিন

  রিপন আহ্সান ঋতু

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:১৪  
আপডেট :
 ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:২২

শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের দিকে সুনজর দিন

বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও শিক্ষক নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন আইন ২০০৫ অনুসারে, শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে হলে আগে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এ আইন অনুসারে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে নিবন্ধিত ও প্রত্যায়িত না হলে কেউ কোনো বেসরকারি স্কুল বা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারবেন না। স্কুল বা কলেজে শিক্ষক হওয়ার জন্য আলাদা আলাদাভাবে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় অর্থাৎ উভয় পদের জন্য আলাদা আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে সিলেবাস, সবকিছুই আলাদা। ফল প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে সনদপত্র পাঠানো হয় স্থায়ী ঠিকানার জেলা শিক্ষা অফিসে। এর আগে ওয়েব সাইটে দেওয়া ফলাফল সাময়িক প্রত্যয়নপত্র হিসেবে ধরা হয়। এই নিয়মের প্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে নেওয়া শিক্ষক নিবন্ধনের মোট ১৩টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় একলাখ সনদধারী শিক্ষক এখনও নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন। এরই মধ্যে আবার ১৩তম নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু ও ১৪ তম পরীক্ষার প্রিলিমিনারির ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। শূন্য পদের সংকট থাকায় অপেক্ষমাণদের নিয়োগ দিতে বিলম্ব হচ্ছে। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, এরই মধ্যে জাল সনদে নিয়োগ নিয়েছেন ৬০হাজার ভুয়া শিক্ষক। যাদের বেতন ফেরত চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে চিঠি প্রেরণ করেছেন। এছাড়া এক থেকে ১২তম ব্যাচের সনদধারীদের করা রিটের বোঝাও চেপে আছে নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন অথরিটি (এনটিআরসি) -এর ঘাড়ে।

আরো পড়ুন: শিক্ষক নিবন্ধনে এসব কী হচ্ছে!

সবমিলিয়ে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এই সনদ অর্জন করতে হয়। প্রথম থেকে দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা একই পদ্ধতিতে হলেও সরকার এটাকে আরও সাংগঠনিক এবং জবাবদিহিতামূলক করার জন্য বেশকিছু কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা লাখো বেকার চাকরি প্রত্যাশীর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল। পুরো প্রক্রিয়া কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বচ্ছ নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া চালুর ব্যবস্থা করে। পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) আদলে মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে। দেশের প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেযোগ্য শিক্ষক নির্বাচন করে নিয়োগ দেওয়া এই কর্তৃপক্ষের কাজ। ত্রয়োদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা থেকে সরকার নতুন পদ্ধতি চালু করেছিল। মূলত ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০০৫’ সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নতুন পদ্ধতি চালু করে। বিধি অনুযায়ী, বছরের নভেম্বরে কর্তৃপক্ষ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে জেলার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শূন্য পদের তালিকা সংগ্রহ করবে। তিনি সে অনুযায়ী চাহিদাপত্র কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের আবেদন গ্রহণ করে যথাক্রমে প্রিলি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণদের উপজেলা, জেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো এই মেধাক্রম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ করবে।

১৩তম নিবন্ধন পরীক্ষায় ৬ লাখ ২ হাজার ৩৩ জন প্রার্থী ছিলেন, তার মধ্যে ৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৭ জন অংশগ্রহণ করেছিল। প্রিলিতে ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৬২ জন উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় ১লাখ ২৭হাজার ৬৬৪ জন অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় প্রতি শূন্য পদের বিপরীতে ৩জন করে পাস দেখিয়ে ১৮ হাজার ৯৭৩ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য উত্তীর্ণ করা হয়। চলতি বছরে মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও আলোর মুখ দেখেনি। নিয়োগ তো দূরের কথা, ত্রয়োদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কর্তৃপক্ষ এক বড় ধরনের গলদ তৈরি করে। তারা শূন্য পদের বিপরীতেই শুধু লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। অর্থাৎ যে উপজেলাতে পদশূন্য রয়েছে শুধু সেই এলাকার লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা প্রার্থীদের উত্তীর্ণের ফলাফল প্রকাশ করে। আবেদনের সময় কোন উপজেলা বা জেলায় শূন্য পদ রয়েছে তা উল্লেখ না করে আবেদন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। কিন্তু ফলাফল প্রদানের সময় পদ শূন্য এলাকার প্রার্থীদের ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। ১৪ তমশিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা-২০১৭-এর প্রিলিমিনারি টেস্টের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। স্কুল পর্যায়ে একলাখ ৪ হাজার ৬৯৪ জন এবং কলেজ পর্যায়ে একলাখ ৫ হাজার ১৮১ জনসহ মোট ২লাখ ৯ হাজার ৮৭৫জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। স্কুল পর্যায়ে পাসের হার শতকরা ২০ দশমিক ৮১ ভাগ এবং কলেজ পর্যায়ে পাসের হার শতকরা ৩৪ দশমিক ৬৪ ভাগ।

আরো পড়ুন: ‘এনটিআরসিএ মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ’

সার্বিক পাসের হার শতকরা ২৬ দশমিক শূন্য ২ ভাগ। এনটিআরসিএ ঐচ্ছিক বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। ১২তম ব্যতীত ১-১১তমে যারা শিক্ষক নিবন্ধন সনদ অর্জন করেছেন তাদের কাছে বেশি নম্বরের গুরুত্ব ছিলনা। ন্যূনতম ৪০ নম্বর পেলেই সনদ অর্জন করা যে তো। তাই তারা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। ফলে অনেক মেধাবী কম নম্বর পেয়ে সনদ অর্জন করায় এখন নিয়োগে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই তাদের মধ্যে চরম হতাশাও অসন্তোষ বিরাজ করে। শিক্ষক নিবন্ধন সনদে ‘নিয়োগের যোগ্য’ কথাটি উল্লেখ রয়েছে। তাহলে তিন বছর পর তারা নিয়োগের অযোগ্য হবেন কেন? রেজিস্ট্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য মনোনীত প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষক যদি লিখিত পরীক্ষায় অনূর্ধ্ব ৪০নম্বর পেয়ে পরবর্তীতে সরকারি প্রাথমিকে নিয়োগ পেতে পারেন, তবে শিক্ষক নিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাবেননা কেন? অন্যদিকে প্রায় ১৫ হাজার ১৯জন পুল শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যদিও তারা দেড়শত টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে এটি স্থায়ী হওয়ার নিশ্চয়তা দেবে না এই শর্তে সই করে ছয়মাস মেয়াদে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্তু নিয়োগের যোগ্য হয়েও শিক্ষক নিবন্ধন সনদপ্রাপ্তরা নিয়োগ পাবেন না কেন? ইতোমধ্যে ১-১২তম সকল শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টে তিনটি রিট দায়ের করা হয়েছে। আরো ২টি রিট দায়ের করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্ট তৃতীয় রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে রিটকারীদের কেন নিয়োগ দেওয়া হবে না, চলমান শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম ও ১৩তমদের পরীক্ষা কেন স্থগিত রাখা হবে না তা জানতে চেয়ে শিক্ষা সচিব, মাউশির মহাপরিচালকও এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন।

এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ মহাবেকায়দায় পড়েছে। তাই তারা ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কোন ধরনের সনদ দিতে নারাজ যদিও বিজ্ঞপ্তিতে সনদ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। সনদ প্রদান করা হবেনা বলেই উপজেলা ভিত্তিক শূন্য পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর প্রাপ্তদের পাস দেখানো হয়েছে। সেখানেও সেই গলদটা রাখা হয়েছে। শূন্যপদ, এলাকা উল্লেখ না করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, যা চাকরি প্রার্থীদের মাঝে নানা প্রশ্নের উৎপত্তি করেছে। এটার অবস্থাও বিগত ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মতো হবে কিনা? এটা মন্ত্রণালয়ের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। তাছাড়া প্রথম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত যে সার্টিফিকেটধারী প্রার্থীরা রয়েছেন সরকার তাদের সবার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অর্থাৎ বিশাল একটি সংখ্যা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রাপ্ত সনদপত্র নিয়ে বসে আছেন, যা কার্যত অকার্যকর। দেশে প্রতিবছর একলাখ স্নাতক বের হচ্ছে। সরকার তাদের নিয়ে কতটা হিসাব কষছে তারাই ভালো বলতে পারবে। বেকারদের অনেকের লক্ষ্য থাকে এই নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে প্রাপ্ত সনদ নিয়ে একটি চাকরি করার।

আরো পড়ুন: নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জট খুলছে

সুতরাং শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা পরিষ্কার করা উচিত। ৬ লাখ ছেলেমেয়ে আবেদন করল, আপনারা একটা মোটা অঙ্কের টাকা পেলেন-এটা হিসাব না করে দায়িত্বের কথা ভাবুন। বেকারদের আবেগ নিয়ে মজমা না করাই শ্রেয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো প্রায় ৬০হাজার শূন্য পদ রয়েছে। প্রথম ই-রিকুইজিশনে প্রায় ২লাখ ৫০ হাজার প্রার্থী আবেদন করলেও বাস্তবে হবে মাত্র প্রায় দেড়লাখ। কারণ লক্ষাধিক প্রার্থীরই স্কুল, কলেজ, প্রদর্শক, কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয়ে একাধিক শিক্ষক নিবন্ধন সনদ থাকায় তারা দুই বা ততোধিক ক্যাটাগরিতে আবেদন করেছেন। ইতোমধ্যে পুরাতন নিয়মে ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিংবডিও নতুনভাবে এনটি আরসিএ কর্তৃক প্রায় ২০ হাজার নিবন্ধনধারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই উচ্চ বেতনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করছেন। অবৈধ সনদধারীর সংখ্যাও একেবারে কম হবেনা।

এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, বেকার শিক্ষক নিবন্ধনধারী আছেন একলাখ দশ হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি। যেখানে প্রায় ৬০ হাজার পদশূন্য রয়েছে সেখানে সকল বেকার শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হবেনা। হয়তো দুই/তিন বছরের মধ্যেই সকলকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে যদি সরকার আন্তরিক হয়। তবে সরকারের আন্তরিকতা কতটুকু হবে তার মাত্রা নির্ভর করছে মহামান্য আদালতের চূড়ান্ত রায়ের উপর। মানবিকতা শুধু মহামান্য আদালত দেখাবেন তা হতে পারে না। সরকারকেও শিক্ষিত বেকার শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের দিকে সুনজর দিতে হবে। আমি আশা নয় বিশ্বাস করি সরকার অবশ্যই মিডিয়া, আদালত ও আইনজীবীদের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহে আন্তরিকতার পরিচয় দিবে যাতে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বৈধ সব নিবন্ধন ধারীদের মেধা ও মননশীলতাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে শূন্য আসনের বিপরীতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে সক্ষম তার পরিচয় দিতে পারেন। সরকার সকল বৈধ শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করবে বলেই বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারী বেকার সমাজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও সংগঠক

আরো পড়ুন: এনটিআরসিএ কি শিক্ষিত বেকারদের জন্য অভিশাপ?​

  • সর্বশেষ
  • পঠিত