ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

নন-এমপিও শিক্ষকদের ভাগ্যের দুয়ার কবে খুলবে?

  মোহাম্মদ নজাবত আলী

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:২৫  
আপডেট :
 ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:২৮

নন-এমপিও শিক্ষকদের ভাগ্যের দুয়ার কবে খুলবে?
গত তিন দিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন নন-এমপিও শিক্ষকরা।

বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই পারে দেশকে অগ্রগতি উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে। রাষ্ট্রের এ মহান গুরুদায়িত্ব কাজটি সম্পন্ন করতে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন শিক্ষক।

বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত দু’ধরনের সরকারি ও বেসরকারি। এ দু’ধরনের শিক্ষায় বাংলাদেশে অর্জন অনেক। আমাদের শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাসের হার প্রায় শতভাগ। সরকারও বিনামূল্যে বই শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দিয়ে একটি যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। জাতীয় স্কেল প্রদান করা হয়েছে। সে স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীরা। তার পরও দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু বৈষম্য রয়েছে। বাড়িভাড়া, মেডিক্যাল ভাতা এখনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক কম পান বেসরকারি শিক্ষকরা। অথচ সরকারি বিদ্যালয় ও বেসরকারি বিদ্যালয়- এই দু’ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই সিলেবাসের আওতায় শিক্ষা প্রদান করা হয়। তবুও দেশের শিক্ষায় বেসরকারি শিক্ষক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

আরো পড়ুন: ‘সংসার চলে স্ত্রীর টাকায়, সন্তানদের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা হয়’

দেশের পাবলিক পরীক্ষার ফল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একেবারে মন্দ বলা যাবে না। শতভাগ পাসের সঙ্গে জিপিএ-৫ ও অনেক শিক্ষার্থী অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯৫ দশমিক ৩৯ শতাংশই বেসরকারি। কলেজের প্রায় ৯৩ শতাংশই বেসরকারি। তবে এরপর বেশকিছু কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। তাই বলতে দ্বিধা নেই, এই বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা যেহেতু একই সিলেবাসে পাঠদান করেন, তাই সঙ্গত কারণে তাদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের অবসানের জন্য দেশের সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণের দাবি জানিয়ে আসছে বেসরকারি শিক্ষকরা অনেক আগে থেকেই। বর্তমান সরকার এ বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতীয় স্কেল প্রদান করলেও এখনো কিছু বৈষম্য রয়েছে। তাই সরকারিকরণ এখন বেসরকারি শিক্ষকদের প্রধান দাবি। তাই সরকারও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা অন্যদিকে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বিপক্ষে নয়। কারণ আমিও একজন শিক্ষক, আমার প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে আমিও লাভবান হব। কিন্তু মূল বিষয় অন্যখানে। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৫ শতাংশের বেশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্কুল, কলেজ, উচ্চ ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কারিগরি এবং মাদ্রাসাসহ প্রায় ৬ হাজারের মতো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ২০ লাখের অধিক শিক্ষার্থী ও লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের একই নিয়ম, সিলেবাস, কারিকুলাম, প্রশ্নপদ্ধতি অনুসরণ করে এবং শিক্ষার্থীরা একই মানের সার্টিফিকেটও পেয়ে থাকে। অথচ শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতাদি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত।

আরো পড়ুন:এমপিভুক্তির আন্দোলন : দ্রুত আলোচনা করে সমাধান করুন

বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেখানে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের পাশাপাশি নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে অবদান রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকারও তা অস্বীকার করছে না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তারা বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ থেকে একেবারে বঞ্চিত। কিন্তু তারাও তো মানুষ, তাদেরও অন্ন-বস্ত্রের দরকার, তারা খেয়ে আছে না অভুক্ত রয়েছে এটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ সরকারের অধীনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের একাডেমিক স্বীকৃতিও প্রদান করেছে। তার পর তারা যথারীতি শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন, পাবলিক পরীক্ষায় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে পাসও করছে। ফলাফলও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভালো। এসব দিক সবই ঠিক আছে কিন্তু ঠিক নেই বেতন-ভাতাদির ক্ষেত্রে। সরকারি অনুদান থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। চাকরি করবেন বেতন-ভাতাদি পাবেন না, পরিশ্রম করবেন পারিশ্রমিক পাবেন না, শ্রম দেবেন শ্রমের মর্যাদা পাবে না এটা অত্যন্ত অমানবিক। কয়েক বছর ধরে সরকার তাদের বারবার এমপিওভুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও তা পূরণ হচ্ছে না। দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নন-এমপিও শিক্ষকদের করুণ দশা। এ করুণ দশায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এক বছর, দুবছর নয়- প্রায় ১৬-১৭ বছর। কী তাদের ধৈর্য! প্রায় দু’দশক ধরে তারা বিনা বেতনে পাঠদান করে যাচ্ছেন অথচ রাষ্ট্র নীরব। এটা রাষ্ট্রের কোন ধরনের আচরণ। বারবার শুধু অর্থ সংকটের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের এ ধরনের নীরবতা তাদের ঠেলে দিয়েছে গভীর সংকটের মুখে।

নন-এমপিও শিক্ষকদের প্রতি সরকার এত উদাসীন কেন? এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষকরা অনেক আন্দোলন করেছেন। মানববন্ধন, অনশনসহ অনেক কর্মসূচি পালন করেছেন। এ তীব্র শীতে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গত কয়েকদিন থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু সরকার তাদের এমপিওভুক্তির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা থেকে সরে এসেছে বারবার। দেশে সাড়ে ৭ হাজারের অধিক নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মরত আছেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যের দুয়ার খুলছে না। তাদের এ অমানবিক জীবনের দিকটা সরকারের অবশ্যই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত।

আরো পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিলেন নন এমপিও শিক্ষকরা

এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের পাশাপাশি তাদের কথাও সরকারকে ভাবতে হবে। তাদের ভাগ্যের দুয়ার কবে খুলবে। এ দুয়ার খোলার চাবিকাঠি সরকারের হাতে। শিক্ষাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত এসব হতভাগ্য শিক্ষকের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র যে কোনো বিবেকবান মানুষের কাছে কষ্ট ও বেদনাদায়ক। তাদের নিয়ে আমি একজন নগণ্য লেখক হিসেবে অনেক ভেবেছি। কিন্তু আমার একার ভাবনায় তো কাজ হবে না। ভাবতে হবে শিক্ষাবিদদের, ভাবতে হবে রাষ্ট্রকে। কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের নিয়ে ভাবে? অথচ শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। সেই মানুষ গড়ার কারিগররা আজ অভুক্ত রয়েছেন। গত সপ্তাহে বেশ কয়েকজন শিক্ষক কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলেছেন, তাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকরাই একটি দেশের উন্নতির মূল চালিকাশক্তি। কারণ তারা যে পেশার সঙ্গে জড়িত এবং যাদের মাঝে আলোকবর্তিকা জ্বালাচ্ছেন সে লাখো শিক্ষার্থীই একটি জাতির মেরুদণ্ড। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে শিক্ষকরা হচ্ছেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু সে মেরুদণ্ড আজ ভেঙে পড়ার উপক্রম অর্থাভাবে। তারা সোজা হবে কীভাবে। রাষ্ট্র কী জবাব দেবে?

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে কারো কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যারা বছরের পর বছর ধরে বিনা বেতনে পাঠদান করে যাচ্ছেন, যারা অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র আর কতকাল নীরব থাকবে। রাষ্ট্রকে নীরবতা ভাঙতে হবে। লাখো শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাকে যারা জাগ্রত করছেন তারাই আজ নিজেরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আজ তারা বড় অসহায়। তাদের আর্তি-আর্তনাদ তো রাষ্ট্রকেই শুনতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র কি তা শুনতে পাচ্ছে না? লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত