ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

যে কারণে প্রাইমারির শিক্ষক পদে যেতে চান না নন ক্যাডাররা

  ফয়জুল ইসলাম মানিক

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১৩  
আপডেট :
 ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:৩০

যে কারণে প্রাইমারির শিক্ষক পদে যেতে চান না নন ক্যাডাররা

বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আমরা নন ক্যাডাররা কেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যেতে চাই না। এই লেখাটিতে প্রাইমেরি স্কুলের শিক্ষকদের প্রতি বিন্দুমাত্র কটাক্ষ অথবা তাদেরকে ছোট করার চেষ্টা করা হয়নি। তারপরেও যদি কারো ‘প্রাইমারি অনুভূতিতে’ আঘাত লাগে তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! যে শিক্ষকদের দ্বারা আমাদের শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠে তাদেরকে মন থেকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি।

বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীদের ৪টা ভাগ আছে। প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণি এবং চতুর্থ শ্রেণি। (যদিও নতুন বেতন স্কেলে শ্রেণিবিন্যাস তুলে দিয়ে গ্রেডবিন্যাস করা হয়েছে তারপরেও এটা রয়ে গেছে)

১ম তিনটা শ্রেনীর বেতন স্কেল এইরূপ:

১ম শ্রেণির বেসিক: ২২,০০০ টাকা (৯ম গ্রেড)

২য় শ্রেণির বেসিক : ১৬,০০০ টাকা (১০ম গ্রেড)

৩য় শ্রেণির বেসিক : ১২,৫০০ টাকা (১১তম গ্রেড)

২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রাইমেরি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদটি তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি গেজেটেড ঘোষণা করেন। কিন্তু অনেক চড়াই উতরাই শেষে তাদেরকে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের অর্ডার অনুযায়ী নন গেজেটেড হিসেবে নিম্নোক্ত স্কেলে বেতন দেয়া হচ্ছে :

প্রশিক্ষণ বিহীন প্রধান শিক্ষক : গ্রেড ১২ (১১,৩০০ টাকা)

প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক : গ্রেড ১১ (১,৫০০০ টাকা)

আমরা নন ক্যাডাররা যদি নিয়োগ পাই তাহলে আমাদের গ্রেড ১২ তেই যোগদান করতে হবে। কারণ আমাদের প্রশিক্ষণ নেই। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের এই বাংলাদেশে পদমর্যাদা আর বেতন স্কেল এক নয়। একজন তৃতীয় শ্রেণির ‘ডিপ্লোমা কৃষিবিদ’ অর্থাৎ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বেতন পান ১১ তম গেডে অর্থাৎ ১২,৫০০ টাকা। আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনার্স করা একজন কৃষিবিদ গ্র‍্যাজুয়েট যদি নন ক্যাডারে প্রাইমেরিতে জয়েন করেন তাহলে তার বেতন হবে ১১,৩০০ টাকা অর্থাৎ ১২তম গ্রেডে। আজব এক দেশে বাস করছি আমরা!

এই দেশে জাতীয়করণ এর মাধ্যমে একদল শিক্ষক বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সমান মর্যাদা পেতে চায়। কোনো রকম কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া উনারা ‘সরকারি কলেজের’ প্রথম শ্রেণির শিক্ষক হয়ে যান। এই শিক্ষকরাও ‘নন ক্যাডার’ প্রথম শ্রেণির শিক্ষকের মর্যাদা পেয়ে যায়।

আর দুই লাখের উপরে চাকরিপ্রার্থী থেকে বিসিএসের তিনটা কঠিন ধাপ পেরিয়ে আমরা ‘নন ক্যাডাররা’ দ্বিতীয় শ্রেণির (বেতন তৃতীয় শ্রেণির) প্রাইমেরি স্কুলের শিক্ষক হই! এটা কি আমাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ নয়? একটা ১ম আর ২য় শ্রেণির জব পাওয়ার আশা করাটা কি নন ক্যাডারদের খুবই অন্যায় আবদার হয়ে যায়?

কেউ কেউ বলবেন নন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিলে ধীরে ধীরে আপনাদের বেতন গ্রেড ১০ম এ উন্নীত করা হবে। বাস্তবতা কি তাই বলে? বাংলাদেশে ৬৪ হাজার সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে। এখানে ৩৭ হাজার প্রধান শিক্ষক নতুন স্কেলে বেতন পাচ্ছেন অর্থাৎ ১১তম আর ১২ তম গ্রেডে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও, অনেক মামলা মোকাদ্দেমা হবার পরেও উনাদের ১০ম গ্রেডে বেতন দেওয়া হয়নি। আর আমরা গেলেই কি আমাদের ১০ম গ্রেডে দিয়ে দিবে?

আর একই পদে নন ক্যাডাররা ১০ গ্রেডে বেতন পেলে অন্যান্য প্রধান শিক্ষকরা কি ১১তম আর ১২তম গ্রেডে সন্তুষ্ট হবে? ক্ষোভ আর আন্দোলন অবশ্যই দানা বাধবে (বাধাটাই স্বাভাবিক, এক পোস্টে দুই বেতন কেন?)।

বাংলাদেশ সরকার কখনোই ৬৪ হাজার প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ১০ গ্রেডের বেতন দেবে না। এত বিশাল পরিমাণ সরকারি কর্মচারীকে ১০ম গ্রেডে বেতন দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া ১০ম গ্রেড প্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারাও আন্দোলন করা শুরু করবে। কারণ ৬৫% প্রধান শিক্ষক হয় সহকারী শিক্ষকদের মাঝখান থেকে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ। ২য় শ্রেণির কর্মকর্তাদের এরকম দাবির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুই বার প্রধান শিক্ষকের পদকে ১০ম গ্রেডে করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ১১৩০০ টাকা বেতনেই আটকে যেতে হচ্ছে আমাদের নন ক্যাডারদের। ৩৬তম বিসিএসে যদি প্রাইমারির প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েই দেয় তাহলে অদ্ভূত এক বৈষম্য দেখতে পাবে বাংলাদেশ (যদিও ৩৪ এ দেখেছে অনেকে)।

কেউ প্রথম শ্রেণির চাকরিতে সর্বসাকুল্য বেতন পাবেন প্রায় ৩৩ হাজার টাকা (কমবেশি হতে পারে)। কেউ দ্বিতীয় শ্রেণির জবে সর্বসাকুল্য বেতন পাবেন প্রায় ২৫ হাজার টাকা (কম বেশি হতে পারে)। আর কাগজে কলমে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রাইমেরির প্রধান শিক্ষকরা পাবেন ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এই একই বেতন পাবেন তৃতীয় শ্রেণির ডিপ্লোমা কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার সহ সরকারের সর্বস্তরের তৃতীয় শ্রেণির পোস্টধারীরা। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস, ডিপ্লোমা পাশ।

আমি বর্তমানে একটা প্রথম শ্রেণির সরকারি প্রকল্পে আছি। আমার অধীনের থাকা ৩য় শ্রেণির কর্মচারীরা পান ১২,৫০০ টাকা স্কেলে। আমি বা আমার ফ্যামিলি কি কখনো চাইবো আমি ওই স্কেলে যাই? তাছাড়া আমার অধীন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা যখন দেখবে তাদের বিসিএস দেওয়া স্যার তাদের স্কেলেই প্রাইমেরির পদে নিয়োগ পেয়েছে তখন কি একটু হলেও তারা আত্মশ্লাঘা অনুভব করবে না।

সত্যি কথা বলতে, সম্মানের কথা বিবেচনা করেই আমাকে এই অস্থায়ী প্রথম শ্রেণীর (৯ম গ্রেড) চাকুরি থেকে স্থায়ী ১২ তম গ্রেডের দ্বিতীয় শ্রেণির পদে জয়েন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ আমার কাছে বিড়ালের মাথা হওয়ার চেয়ে বাঘের লেজ হওয়া অনেক ভাল। ( বি. দ্র: প্রাইমারি স্কুলের পার্মানেন্ট তৃতীয় শ্রেণির সমমানের ১৮০০০ টাকা বেতনের চাকুরির চেয়ে আমার অস্থায়ী প্রকল্পের প্রথম শ্রেণির ৩৩৭০০ টাকার চাকুরি আমার নিকট উত্তম বলে বুঝিছি! দয়া করে কেউ এটাকে নিজের মত ব্যাখা করে প্রাইমেরি স্কুলের টিচারদের খাটো করেছি বলবেন না)

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেউ প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে ১২তম গ্রেডে নিয়োগ পেলে থ্রি ইডিয়টস এর সাইলেন্সার এর মত তুচ্ছার্থক "মাস্টারজি" ডাকার মত লোকের অভাব নেই এই বাংলাদেশে। বাংঙ্গালীর মানসিকতাটাই এরকম! আমি জানি, এই লেখাটা পড়ার পর কিছু মানুষ কমেন্ট Frequently Asked Questions (FAQ) গুলো করবেন :

১. পিএসসি আপনাদের চাকুরি দিতে বাধ্য নয় বা হেড টিচার হিসেবে যোগ দিতে আপনাকে বাধ্য করছে না

২. এত লোভ কেন, যা পাইছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন।

৩. ১ম, ২য়, ৩য়, ৩৩তম ইত্যাদি বিসিএসে নন ক্যাডাররা তো কিছুই পায়নি কিন্তু আপনারা তো তাও জব পাবেন একটা। শোকরানা নামাজ পড়েন এইজন্য।

৪. আপনার না হয় এই জব দরকার নাই কিন্তু নন ক্যাডার কেউ কেউ তো এইটাতেই সন্তুষ্ট।

৫. আপনাদের মত মেধাবীরাই এই প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের সঠিকভাবে (!) গড়ে তুলতে পারেন। আপনাদের ওইখানেই যাওয়া উচিত।

এই সকল প্রশ্নের সম্মিলিত জবাব একটাই :

৩৫ তম নন ক্যাডারে বেকারদের অভিভাবক প্রিয় সাদিক স্যার সবাইকে ৯ম এবং ১০ গ্রেডে চাকরি দিয়েছিলেন। আমাদের মন্ত্রণালয়েও হাজার হাজার ৯ম, ১০ম গ্রেডের ফাঁকা পোস্ট আছে। এখান থেকে ২৭০০ জব পাওয়ার আশা করাটা কি খুবই অসম্ভব, অন্যায় একটা আবদার? এখন দয়া করে আমাদের জায়গায় নিজেকে একটু কল্পনা করুন।

২ লাখের বেশি প্রিলিমিনারি ক্যান্ডিডেটের মধ্যে থেকে থেকে ১৩৬৭৯ জনের একজন হয়ে প্রিলি পাস করেছেন। এরপর লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ৫৯৯০ জনের মধ্যে ভাইভা দিয়ে সর্বশেষ আপনি নন ক্যাডারের ২৭০০ জন এর মধ্যে জায়গা নিয়েছেন। পুরো প্রক্রিয়াটিতে আপনাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আড়াই বছরের উপরে!

আড়াই বছর অপেক্ষা করার পর যখন আপনি শুনবেন আপনি তৃতীয় শ্রেণির সমমানের একটা পোস্ট পেতে যাচ্ছেন তখন বুঝবেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কতটা তীব্র, কতটা কষ্টের! বিশেষ করে বাবা মাকে হতাশ করার মত কষ্টের ব্যাপার খুব কমই আছে। যারা এই আড়াইটা বছর আপনার মুখ চেয়ে ছিল!

কারণ আমরা, আমাদের বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই আশা করে বসেছিলাম যে ৩৫তমের মত সম্মানজনক এবং সমপদমর্যাদা সম্পন্ন একটা চাকুরির ব্যবস্থা হবে। আর আমরা কি পেতে যাচ্ছি? বিচারের ভারটা আপনাদের ওপরই ছেড়ে দিলাম।

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত