ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

একজন শফিকুল কবির

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৫৯

একজন শফিকুল কবির

আজ ১৩ই অক্টোবর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইত্তেফাকের চীফ রিপোর্টার শফিকুল কবির-এর মৃত্যু দিবস। ২০১৩ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। মৃত্যুদিবসে তাকে স্মরণ করছি। দোয়া করি ওপারে তিনি ভালো থাকুন। তার সম্পর্কে আমার এ লেখাটি দু’বছর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মুখপত্র ‘রিপোর্টার্স ভয়েস’-এ প্রকাশিত হয়। এখানে লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

প্রিয় সদস্য, শফিকুল কবিরের কথা মনে আছে? ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির (ডিআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবির ভাই। হ্যাঁ, আমি তার কথাই বলছি। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, ফিরেও আসবেন না কোনো দিন। তবে রয়ে গেছে তার অন্যতম র্কীতি। এই ইউনিটি। বেশি করে বলা হলো? না, মোটেই না। তার সাহসী নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রিপোর্টারদের আবেগ আর স্বতঃস্ফূর্ততা একাকার হয়ে শুরু হয় রিপোর্টাস ইউনিটির রাজকীয় যাত্রা। রাজকীয় বলার কারণ আছে। তিনি ছোট করে কোনো চিন্তা করতেন না। সহকর্মী হিসাবেও দেখেছি। ডিআরইউ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবেও তার কার্যক্রমে এমন প্রমাণ পেয়েছি।

এক বিকেলে এসে বললেন, ইউনিটির প্রথম সম্মেলন হবে হোটেল সোনারগাঁয়। প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি বিস্মত হয়ে জানতে চাই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেয়েছেন? বললেন না, তবে সোনারগাঁয় বুকিং দিয়ে এলাম। সম্মতি ছাড়াই বুকিং? যদি এদিন অন্য কোনো কার্যসূচি থাকে? সোনারগাঁয় হোটেলের বুকিং এর টাকা পেলেন কোথায়? স্বভাবসুলভ ভংগিমায় জবাব, সরদার তুই আমারে চিনলিনা। সোনারগাঁয় বুকিং দিতে শফিকুল কবিরের টাকা লাগে? না, নামই যথেষ্ট। আর এদিন শেখ হাসিনার কর্মসূচি নেই জেনেই তারিখ ঠিক করেছি। আমরা সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করলে ফিরাইবেন না। অবশ্যই আসবেন। ‘শেখের বেটিরে তোরা চিনিস না, আমরা চিনি’। আমি আরও বিস্মত। ইত্তেফাকের রিপোটিং বিভাগে তখন অবস্থানরত অন্য রিপোর্টারদেরও একই অবস্থা। বাস্তব হলো কবির ভাই ছিলেন এমনই। তার অনেক কথা আমরা সিরিয়াসলি নেইনি। পরে আবার দেখেছি হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে একটি নতুন সংগঠনের প্রথম সম্মেলন, প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী, স্থান, সোনারগাঁ হোটেল। পূর্ব তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। আগেই বলেছি সংগঠনটি আবেগের। আর বৈরীতা ছিল অনেক। কোনো বড় ত্রুটি বিচ্যুতি মানে অংকুরেই বিনষ্ট। তাই কবির ভাইয়ের কথায় বিষ্ময়ের সঙ্গে উদ্বেগও যুক্ত হলো।

পুরোনোরা জানেন, নতুনরা হয়তো অনেকে জানেন না রিপোর্টাস ইউনিটির গঠনকে তৎকালীন কিছু সংবাদিক নেতা ভালো চোখে দেখেন নি। ইউনিটিতে সক্রিয় ভূমিকা থাকার কারণে বেশ ক’জন রিপোর্টারকে নিজ নিজ অফিসে বিরূপ অবস্থায় পড়তে হয়। চাকুরীচ্যুতির হুমকি আসে। এমনই বিরূপ অবস্থায় আমাদের এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চাকুরী ত্যাগ করতে বাধ্য হন তবুও ইউনিটি ছাড়েন নি। অবশ্য পরে তিনি আবার স্বপদে যোগদান করেন। এরকম একটি পরিবেশেই প্রথম সম্মেলনের আয়োজন। তাই কবির ভাইয়ের উচ্চভিলাসী ও হুট-হাট সিদ্ধান্ত আমাদের অনেকের উদ্বেগের কারণ ছিল। আরো সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। বিকেলে অফিসে এসেই কবির ভাই বললেন, কাল যেতে হবে। তুই সাড়ে ১১টায় প্রেসক্লাবে থাকবি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ সাড়ে ১২টায়। অন্যদের এখনই বলছি। এই বলে ইত্তেফাকের অপারেটরকে কিছু নাম দিলেন। তার পর একজনের পর একজনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। কাজ শেষে আমি বললাম, কবির ভাই আমার তো কাল গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট আছে। আপনিই দিয়েছেন। যাব কি করে? তিনি তখন চিফ রিপোর্টার আর আমি সিনিয়র রিপোর্টার। বললেন, বাদ দে অ্যাসাইনমেন্ট। আমি চিফ রিপোর্টার, তোকে কে কি বলবে? তখন খাতা নিয়ে গেলাম, তার নিজের হাতের লেখা। দেখে বললেন, না, সমস্যা আছে। তোর যেতে হবে না। অ্যাসাইনমেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার আর যাওয়া হলো না। পরদিন সকালে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে সোজা অফিসে এসে লিখতে থাকি। কবির ভাইয়ের গলার আওয়াজে চোখ তুলেই দেখি মুখে তার তৃপ্তির হাসি। আমার চাহনিতে তিনি গলার আওয়াজ আরো বাড়িয়ে দিলেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে আসতে রাজি হয়েছেন। আরো কিছুক্ষণ হৈ-চৈ করে তিনি নিজ আসনে বসলেন। আমি কাজ শেষ করে তার টেবিলের সামনে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এরই মধ্যে আমি জানতে চাই সোনারগাঁয় শুধু হল ভাড়া না খাবার ব্যবস্থা থাকবে।

এবার তিনি উচ্চস্বরে বললেন, খাওয়া ছাড়া শফিকুল কবিরের কোনো অনুষ্ঠান হয়? কথাটা সত্য। কবির ভাই ভোজন রসিক ছিলেন। নিজেও খেতেন প্রচুর, খাওয়াতেও ভালোবাসতেন। প্রেসক্লাবে তার খাবার নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা আছে। পুরোনো সাংবাদিকরা জানেন। কবির ভাই খেতে গেলে ক্লাবের বেয়ারারা সতর্ক থাকতেন। কোনো আইটেম এক-দুই প্লেট থাকলে জানাতো না। কেন না তিনি যাই খেতেন, তিন-চার প্লেট। তখনকার রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহলেও তার ভোজন রসিকতা নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল। আবার সম্মেলনে ফিরে আসি। সকালে হলো সম্মেলন। দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজ। ডি আর ইউ-এর তখন সদস্য ছিল পাঁচ’শর মতো। অতিথিসহ সব মিলে সাত’শ প্লেট খাবারের অর্ডার দিয়েছেন জানান কবির ভাই। সেই সময়ে প্রতি প্লেট খাবারের মূল্য ছিল বার’শ টাকা। খাবারের টাকার অংকটা বেশ বড়। এ টাকা ম্যানেজ হয়েছে কিনা জানতে চাই। বললেন, হয়ে যাবে। তুই খামখা বেশি বেশি চিন্তা করিস। সম্মেলনের দিন ঘনিয়ে আসে। আমি বারবার একই প্রশ্ন করি। কবির ভাই বরাবরই নির্বিকার। তার মধ্যে ভাবনার লেশ নেই। আগের দিন শুধু বললেন, প্রধানমন্ত্রী যখন সম্মেলনে আসবেন তখন সমস্যা হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তো দিতে পারেন। তাছাড়া অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দিবেন। তাঁর এই হেয়ালি জবাবে আসলে আমি আরো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি।

পরদিন সম্মেলন। কানায়-কানায় ভর্তি সম্মেলন স্থল। অতিথিদের মধ্যে বেশ ক’জন মন্ত্রী, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট সময়ে এলেন। সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হলো সম্মেলন। এবার মধ্যাহ্ন ভোজের পালা। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও কয়েকজন ব্যবসায়ী-শিল্পপতির জন্য আলাদা ব্যবস্থা। কবির ভাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন। আমিও আছি। ভোজ শেষ। প্রধানমন্ত্রী উঠবেন। অন্যরাও প্রস্তুত। এমন সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নটি তুললেন, সোনারগাঁয়ে সম্মেলন। টাকা এলো কোত্থেকে? কবির ভাই যেন এমন একটি প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সাথে সাথে উত্তর, আমরা টাকা পাব কোথায়। আপনি যেখানে আছেন আমাদের চিন্তা কি? তার এ কথায় আমি রীতিমতো অবাক। বলে কি? প্রধানমন্ত্রীকে এনে এভাবে কথা। মনে হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও যেন প্রস্তুত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার পাশে থাকা দেশের একজন বড় শিল্পপতির দিকে তাকালেন। শিল্পপতিও যেন বুঝে গেলেন। বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। ব্যাস, মধ্যাহ্ন ভোজের স্পন্সর ম্যানেজ। কবির ভাইয়ের মুখে সেই কি তৃপ্তির হাসি। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও অতিথিরা বিদায় নিলেন। কবির ভাই আমি এবং ইউনিটির অন্যন্য নেতৃবৃন্দ তখনো হোটেলে। আমি বললাম, আপনি কি ঘটনাটা ঘটালেন ভেবেছেন? উত্তর, ‘ওই তোরা কি জানিস। আমি বলিনি, শেখের বেটিরে আমি চিনি। আমরা পুরোনো সাংবাদিক, তোরা কয়দিনের’? সাথে আরেকটি কথা বললেন, আমি শুধু নিশ্চিত করেছিলাম ওই শিল্পপতি (ভোজের স্পন্সর) যেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। আর তারিখ আনার দিনই প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে ছিলাম, আমাদের প্রথম সম্মেলন। আপনাকে কিছু সহায়তা করতে হবে। সে দিন তিনি কিছু বলেননি। আজ দেখলিতো ঠিকই ব্যবস্থা করে গেছেন।

এ হলো শফিকুল কবির। আমাদের কবির ভাই। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এমন ভাবে হুট-হাট করে কোন অনুষ্ঠান করা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

কৈফিয়ত : আমি লেখার টেবিলে বসার আগেও ভাবিনি এ লেখাটি কবির ভাইকে নিয়ে লিখবো। ভেবেছিলাম কি ভাবে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে প্রথম টেলিভিশনটি এলো, ক্যান্টিন হলো, ফ্রীজ, এয়ার কন্ডিশনার, টেবিল-চেয়ার এলো, কম্পিউটারে কি ভাবে ভোট শুরু হলো এসব বিষয় নিয়ে একটি লেখা দিবো। কিন্তু লিখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ে গেল কবির ভাইয়ের নাম। প্রতিষ্ঠবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রিপোর্টাস ভয়েসের বিশেষ সংখ্যা বের হচ্ছে। রিপোর্টার্স ইউনিটি আর কবির ভাই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই তাকে নিয়েই লেখা শুরু এবং শেষ। তবে এ কথা বলতেই হবে ইউনিটির আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে প্রতিটি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং প্রতিটি রিপোর্টারের অনেক অনেক অবদান। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা কালের সাহসী নেতৃৃবৃন্দের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আবেগের সংগঠন আবেগ দিয়েই রিপোর্টাররা আগলে রেখেছেন। ভবিষ্যতেও রাখবেন।

(পূনশ্চ : আমার লেখায় তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে আমি ক্ষমা প্রার্থী। কেননা আমি লিখেছি আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমার দেখা কবির ভাই এবং প্রথম সম্মেলন নিয়ে তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত কথোপকথনের ভিত্তিতে। কেননা রিপোর্টার্স ইউনিটির বিষয়ে কবির ভাই আমার সাথে আলোচনা করতেন। তিনি নিজেই বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করতেন। আমার আগ্রহ ছিল বলেই হয়তো আলোচনা করতেন। আর এই আগ্রহের কারণেই হয়তো সম্মানিত সদস্যরা দু’বার আমাকে ইউনিটি পরিচালনার সুযোগ দিয়েছিলেন।)

লেখক : সাবেক সভাপতি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত