ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২২ মিনিট আগে
শিরোনাম

এই মুখস্তবিদ্যা ক্যাডার হওয়ার পর কতদিন মনে থাকবে?

এই মুখস্তবিদ্যা ক্যাডার হওয়ার পর কতদিন মনে থাকবে?

বিসিএস প্রস্তুতি নেয়া একজন একবার আচমকা বলেছিলেন, শরৎচন্দ্র পাদে।

আমি চরম বিস্মিত হয়ে বললাম, শরৎচন্দ্র পাদে মানে? এটা কোন ধরণের কথা?

তিনি বিজ্ঞের মতো হাসি বললেন, এটা মনে রাখার কৌশল।

- কী মনে রাখার কৌশল?

- শরৎ মানে শরৎচন্দ্র নিজে। চন্দ্র মানে চন্দ্রমুখী। পা তে পার্বতী, দে তে দেবদাস। শরৎচন্দ্রের দেবদাস বইয়ের প্রধান চরিত্র মনে রাখার কৌশল।

আমি প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিলাম। এ কেমন মনে রাখা?

বহু আগে থেকেই মোঘল রাজাদের নাম সিরিয়ালি মনে রাখার একটা কৌশল প্রচলিত আছে। বাবার হইল একবার জ্বর,সারিল ঔষধে। বাবর, হুমায়ূন, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান আর আওরঙ্গজেব। আমরা প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম ক্লাস সেভেন বা এইটে। সংক্ষেপে মনে রাখতে গিয়ে আমার এক বন্ধু বিশাল বিপদে পড়েছিল। তাকে স্যার প্রশ্ন করেছিলেন, আওরঙ্গজেবের বাবার নাম কী?

সে ঠাস করে বলেছিল, হুমায়ূন।

হুমায়ূনের বাবার নাম কী?

- জাহাঙ্গীর।

তার কোন দোষ ছিল না। সে সিকুয়েন্সটা নিজের মতো করে চেঞ্জ করে ফেলেছে। "বাবুরের একবার জ্বর হইল, ঔষধে সারিল।"

সামান্য হিসেবের হেরফেরে ছেলে হয়ে গেল বাবা, দাদার দাদাও এখানে হয়ে বাপ।

আশ্চর্যের ব্যাপার, এখনো কোন বিসিএস ক্যান্ডিডেটকে দেখি এই লাইন দিয়ে মোঘল সম্রাটদের নাম মনে রাখছে!

আমার কেন জানি মনে হয় আমাদের বিসিএস প্রিপারেশনের সিস্টেমটা ত্রুটিহীন না। বিভিন্ন বইয়ের প্রধান চরিত্র নিয়ে ছক গাইড বই এ পাওয়া যায়। সেখানে পদ্মানদীর মাঝির কপিলা কুবের, দেবদাসের, পার্বতী- দেবদাস, শেষের কবিতার অমিত- লাবণ্য, বিষাদ সিদ্ধুর ইমাম হোসেন থেকে নিয়ে কী নেই?

একজন মানুষকে বাংলা সাহিত্য খুব ভালো জানতেই হবে এমন কথা না। কিন্তু যে মানুষটাকে দেবদাস বইয়ের চরিত্র মনে রাখতে গিয়ে "শরৎচন্দ্র পাদে" বলে একটা লাইন আবিষ্কার করতে হয়, পদ্মানদীর মাঝির চরিত্রের নাম মুখস্ত করতে হয়, বনলতা সেন কার কবিতা সেটা মুখস্ত করতে হয় তার উপর বাংলা সাহিত্য চাপিয়ে দেয়ার মানে কী?

গাইড বইয়ে মাঝে মাঝে হাস্যকর রকম কিছু লাইন দেখা যায়। যেমন কবর কবিতা ১১৮ লাইনের, "পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো" ইহা নবকুমারকে বলা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কবর কবিতা কত লাইনের এটা মুখস্ত করা খুব জরুরি কিছু? কবর কবিতা যাদের পুরোটাই মুখস্ত আছে, যারা শতশত বার আবৃত্তি করেছেন তাদেরও তো মনে থাকার কথা না কবর কবিতার লাইন সংখ্যা কত। কবিতা মুখস্ত না করে লাইন মুখস্ত করে কী লাভ? পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো, এই লাইনটা বিসিএস অব্দি এসে যদি কেউ না জেনে থাকে তার জোর করে জানানোর আর দরকার আছে?

এমনও অপশন দেখছি, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল....... বনলতা সেন।

ক. নওগার খ. ঝিনাইদহের

গ. নাটোরের ঘ. বগুড়ার।

আমি আবারো বলছি কারো সাহিত্য জানতেই হবে সেটা কথা না। কিন্তু যে বনলতা সেন কবিতাটা জীবনে একবারও পড়ে নি, তাকে বিসিএস এর সর্বোচ্চ লেভেলে এসে কবিতা নিয়ে কোন প্রশ্ন করা, ধরা বা সেই পথে নিয়ে যাওয়া বাধ্য করা তার নিজের ক্ষতি, সেই সাথে সাহিত্যেরও ক্ষতি।

বাংলা ব্যাকরণ, বিশ্ব সম্পর্কে একটা গ্রস ধারণা রাখা, কিছু ম্যাথ, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা ন্যাটো সম্পর্কে ধারণা যে কারো থাকা উচিত। বেসিক ব্যাপার বা চলমান বিশ্ব নিয়ে আগাগোড়া মূর্খ কাউকে ক্যাডার করা উচিত না। কিন্তু "ফিদে আসুন" দিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ মুখস্ত করানো, ছন্দ দিয়ে রাজধানীর নাম মুখস্ত করানো, হজম অযোগ্য জিনিষ হজম করানো, হাইতির প্রধানমন্ত্রীর নাম মনে রাখা...এসবের স্বার্থকতা কোথায় কে জানে!

জোর করে করে এই মুখস্তবিদ্যা ক্যাডার হয়ে যাওয়ার কতদিন পর পর্যন্ত মনে থাকবে? একজন বহু কষ্টে সৃষ্টে "পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো" মনে রেখে যখন ডাক্তার হবে, কিছুদিন পর আর তার নবকুমারের নাম মনে থাকবে না। পাদাপাদির কথাও মন থেকে উবে যাবে। তার মাথায় তখন কাজ করবে কেবল একটাই ব্যাপার "রোগী তুমি কী আমার চেম্বারের রাস্তা হারাইয়াছো?"

কীভাবে কী করলে সিস্টেম ত্রুটিমুক্ত হবে সেটা আমি জানি না। আমি এত বড় কথা বলার যোগ্যও নই। তবে আমার মনে হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে এই তোঁতাপাখি নির্ভর সিস্টেম থেকে সরে আসা উচিত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলমান বিশ্ব, ইতিহাস নিয়ে যদি প্রশ্ন করতেই হয়, তবে যারা এসব ব্যাপারে সব সময়ই চর্চা রাখে তাদেরকেই বেছে নেয়া উচিত।

যে যত বড় তোতাপাখি সে তত সফল, এটা হতে পারে না। তারচেয়ে এসব সাহিত্য সংস্কৃতি বা সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা একেবারেই বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। ট্যাকনিকাল ক্যাডাররা কেবল তাদের নিজের সাবজেক্ট নিয়েই পড়বে, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারদের নিজের বিষয় ভালো জানলেই হবে, এটাই ভালো না?

আর যাই হোক, শরৎচন্দ্রকে দিয়ে পাদ মারানো উচিত না। আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক। আমার নিজেরই অপমান লাগে।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় মানুষ তোর মাথায় ঠাডা পড়ুক বলবে না, বলবে তোর মাথায় বিসিএস পড়ুক।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত