ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের কষ্টের গল্প

  কেএমএস আলম টুটুল

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:১৭

বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের কষ্টের গল্প

মা কেমন আছেন? বয়সের ভারে ভেঙে যাওয়া গালে ফোকলা মুখে হেসে যা বললেন তা বোঝা সহজ ছিল না....আগে থেকেই কান বাড়িয়ে ছিলাম বলেই বুঝতে পারলাম বলছেন, ভাল আছি....। শেলী আপা জিজ্ঞেসা করলেন, তোমার কয় ছেলে? আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, দুই ছেলে। শেলী আপা আবার জিজ্ঞেসা করলেন, বাড়ি যাবা? ডুকরে কেঁদে উঠলেন, অনেকটা আর্তনাদ করেই বললেন না.....।

আপা আবারও জিজ্ঞেসা করলেন, কেন? যা বললেন তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না.....দুঃখে লজ্জায় কাতর হয়ে মা বললেন, মা রে..... ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে এউএসটি স্কুল অব বিজনেস আল্যামনাই এসোসিয়েশন এর যেসব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন তাদের কারও পক্ষেই চোখের পানি ধরে রাখার মতো অবস্থা ছিল না।

বিস্ময়ে, কষ্টে কিছুক্ষণের জন্য সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কেউ কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিল না, সম্ভবও ছিল না.....মনের ভেতরে সবাই যে উত্তরটা হাতড়ে বেড়াচ্ছিল সেটা হচ্ছে লজ্জাটা আসলে কার?

বলছিলাম ঢাকার মৈনারটেক, উত্তরখান উত্তরায় অবস্থিত ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম’ এর একজন মায়ের কথা। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস বিভাগের ২৩ তম ব্যাচের তৌফিকের কাছ থেকে প্রথমে জানা। সেখান থেকে ‘এক টাকার দান বাক্স’ (একটি সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান) -র সাথে এর সম্পর্ক এবং তাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এইউএসটি স্কুল অব বিজনেস আল্যামনাই এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম’ এর জন্য কিছু করার প্রত্যাশা থেকেই আমাদের ছোট্ট প্রয়াস। সেখানে যাওয়া।

সৈয়দা সেলিনা শেলী আপার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া এই বৃদ্ধাশ্রম। উনার কাছ থেকেই আমরা জানলাম এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ার পেছনের ইতিহাস। অবহেলিত এই মা বোনদের জীবনের নিদারুণ গল্প আর সেখান থেকে কিভাবে টুনটুনি, জোহড়া বিবি, নুরিয়া বেগম, সামসুন নাহার, মাহমুদা, তানিয়া, নাজনিনের মতো ৩৫ জন হতভাগা মানুষের এই বৃদ্ধাশ্রমে আসা।

এখানে আশ্রিত যাদের বেশিরভাগই শারিরীক অথবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। জরাজীর্ণ সেই ভবনে নেই গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি কিংবা পানির সুব্যবস্থা। নেই চিকিৎসার সুব্যবস্থা। কিন্তু সেখানে গাদাগাদি করে থাকা মানুষগুলোর শারিরীক কিংবা মানসিক যেই কষ্টই থাকুক না কেন, মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার আর সম্মানটুকু অবশ্যই আছে। এদের কাউকে সাভার, কাউকে টংগী, কাউকে পুরানো ঢাকার কোন এলাকা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে সম্পূর্ণ নগ্ন, অত্যাচারিত কিংবা আহত অবস্থায়।

মানুষগুলো ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিজের ময়লা নিজেই খেয়েছে বহুদিন। বিছানায় শুয়ে থাকা ফুটফুটে শিশুটির সম্পূর্ণভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবতী মা প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বারান্দার রেলিং ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে জবুথুবু হয়ে বসে আছে এক কোণায়। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েও কোন অমানুষের যৌনলিপ্সা থেকে মুক্তি পায়নি মেয়েটা।

এই সমাজে পাগলদেরও রেহাই নেই........এই মানুষগুলো ফিরে যেতে চায় না আর অবহেলিত, নিপীড়িত কিংবা অসম্মানের কোন জায়গায়।

প্রচার নেই সেভাবে, বেশি কেউ জানেনা তাদের কথা, অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এই বৃদ্ধাশ্রমের কথা। দৈনতা আর দুর্দশা এদের তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত। এমনকি মারা গেলেও পোহাতে হয় অপরিসীম ভোগান্তি। একবেলার খাবার জোগার করতেও এদের হিমশিম খেতে হয়। নিয়মিতভাবে সাহায্যর কোন উৎসও এদের নেই। সাহায্যর কথা যতবার না বলেছেন আমাদের তার চেয়ে আরও বেশিবার বলেছেন এই ধরনের মানুষ থাকলে সন্ধান দিতে।

একটা বেলা কাটিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম আমরা, তখন কিছুতেই নিজের মনকে বোঝাতে পারছিলাম না । কষ্ট তো অবশ্যই হচ্ছিল কিন্তু কেন জানি খুব রাগও হচ্ছিল, কানের কাছে বাজছিল ‘মা রে’।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত