ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

বড়ি বেচে বড়লোক

  নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৬  
আপডেট :
 ২১ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০১

বড়ি বেচে বড়লোক

বাঙালির একটি সুস্বাদু খাবার ডালের বড়ি। ভাজা পুঁটি মাছের সঙ্গে ডালের বড়ি দিয়ে তরকারী কিংবা কৈ মাছের সঙ্গে- এ কথা মনে পড়লেই জিভে পানি এসে যায়। শীতের সকালে পাতে শুধু ডালের বড়ি থাকলেই পেটপুরে ভাত খেয়ে অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত কবিতা ‘মাগো, ওরা বলে’তে ছেলে ফেরার অপেক্ষায় ব্যাকুল মা তার জন্য ডালের বড়ি শুকিয়ে রাখেন।

ডালের বড়ির চাহিদা থাকে বছর জুড়েই। তবে শীত মৌসুমে চাহিদা বাড়ে। এ সময় গাঁওগেরামের হাঁটবাজারে এই বড়ি বেশি দেখা যায়। শহরেও এখন এর জনপ্রিয়তা রয়েছে।

ব্যাপক চাহিদা আছে বলেই এই বড়ি বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী, টানমুশরী ও কাঞ্চন এলাকার মানুষ। প্রায় এক হাজার নারী পুরুষ এই বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা চালাচ্ছেন। ডালের বড়ি এখন তাদের জীবিকার অবলম্বন।

এ অঞ্চলে ডালের বড়ির ব্যবসায় যিনি অগ্রপথিক হিসেবে অন্যদের পথ দেখিয়েখেন, তিনি বজ্র বালা (৬০)। তার গুনেই ওই গ্রাম ৩টি এখন ‘মাষকলাইয়ের বড়ির গ্রাম’ নামে পরিচিত।

দৈন্য ঘোচাল বড়ি:

উপজেলার রূপসী গ্রামের মেয়ে বজ্র বালা। ১৯৬২ সালে উত্তরপাড়া গ্রামের জীবন চন্দ্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অর্ধহারে-অনাহারে চলতো তাদের দিন। ১৯৮৯ সালে স্বামী মারা গেলে তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন বজ্র। অন্যের বাড়িতে ধান ভানার কাজ করে যে টাকা পেতেন তাতে সংসার চলতো না মোটেও। শাকপাতা খেয়ে দিন কাটত তাদের। একপর্যায়ে দেবর রবী রায় তাকে মাষকলাইয়ের বড়ি বানিয়ে বিক্রি করার পরামর্শ দেন।

১৯৯২ কিংবা ৯৩ সালে বজ্রবালা বাজার থেকে ১৫ কেজি মাষকলাই কিনে এনে বড়ি বানিয়ে বিক্রি করেন। এতে লাভ হয় ৩ শ’ টাকা। উৎসাহ পেয়ে বজ্রবালা বড়ি বিক্রির ব্যবসায় লেগে থাকেন। মাত্র দেড় বছরেই ব্যবসা জমে ওঠে। মুনাফার টাকায় তিনি দুটি গাভী, তিনটি ছাগল, হাঁস-মুরগি কিনে লালন পালন শুরু করেন। এভাবে মুছে যেতে থাকে তার সংসারের দৈন্য দশা। বড়ি বিক্রির টাকায় বজ্রবালা মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে ঘর তুলে দিয়েছেন। কিনেছেন দুই বিঘা জমি। পুকুরে মাছ চাষ করেছেন।

তৈরি প্রনালী:

বজ্রবালা জানান, বাজার থেকে খোসা ছাড়ানো মাষকলাই এনে ১০ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভেজানো মাষকলাই ঢেঁকিতে ভেনে ‘লেই’ তৈরি করতে হয়। লেই পাত্রে নিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বড়ি তৈরির উপযোগী করতে হয়। পরে হাতের সাহায্যে ছোট ছোট গুটি (বড়ি) বানিয়ে টিনের ওপর লাইন করে সাজাতে হয়। দু’তিন দিন রোদে শুকানোর পর বড়ি তুলে সংরক্ষণ ও বিক্রি করা হয়। একজনের পক্ষে দিনে পাঁচ কেজি বড়ি তৈরি করা সম্ভব।

তিনি বলেন, ১০ কেজি মাষকলাইয়ে নয় কেজি বড়ি হয়। পাইকারেরা গ্রামে এসে বড়ি কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি বড়ি তৈরিতে ১৬০-১৭০ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ২৪০-২৫০ টাকায়।

সরজমিনে একদিন:

রূপগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে তারাবো পৌরসভার রূপসী গ্রাম। এক সকালে ওই গ্রামে গিয়ে অনেক নারী-পুরুষকে ডালের বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত দেখা যায়। কেউ মাষকলাই ঢেঁকিতে ভানছেন, কেউ সদ্য তৈরি করা বড়ি রোদে শুকাচ্ছেন। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও বসে নেই।

বজ্রবালার বাড়িতে গিয়ে দেখ যায়, বাড়ির উঠানে বসে তিনি বড়ি তৈরি করছেন। পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিরা তাকে সহযোগিতা করছেন। কেউ কলাই ভানছেন, কেউ বড়ি তৈরি করছেন।

অতীতের কষ্টের দিনগুলোর কথা এখানো ভোলেননি বজ্রবালা। এ কারণে বয়সেও তিনি পরিশ্রম করেন। ঘরের কাজ ছাড়াও তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে দুস্থ গরীবদের বড়ি তৈরি করা শিখিয়ে স্বনির্ভর হতে সহযোগিতা করছেন।

বজ্রবালার মেয়ে জোৎস্না রানী ও পুত্রবধূ গৌরিরানী বলেন, তাদের মা ও শ্বাশুড়ির ব্যাপারে লোকজন যখন প্রশংসা করে, তখন তারা গর্ববোধ করেন।

রূপসীর মতো টানমুশরী ও কাঞ্চনেও একই চিত্র দেখা যায়।

বজ্রবালা মডেল: রূপগঞ্জের বড়িপল্লীর লোকজনের কাছে বজ্রবালা এখন মডেল। বজ্রবালার পথ অনুসরণ করে যারা সফল হয়েছেন তাদের একজন অনিতারানী (৩৫)। স্বামী দিরেন্দ্র এর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটছিল তার। বজ্রবালার কাছ থেকে বড়ি তৈরির কৌশল শেখার পর প্রতি মাসে তার গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। সন্তানদের তিনি বিদ্যালয়ে দিয়েছেন, বাড়িতে টিনের ঘর তুলেছেন, দুটি ছাগল ও ৫ শতক জমি কিনেছেন।

অন্ধ স্বামী, দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে মনিকা রানীর সংসার। ডালের বড়ির বিক্রির টাকায় তার ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। তিনিও টিনের ঘর তুলেছেন, জমি কিনেছেন, হাঁস-মুরগি পালন করছেন। একই ভাবে বজ্রবালার পথ ধরে সংসারের উন্নতি ঘটিয়েছেন শিখারানী, মালুতিরানী, সাবিত্রী, পলিবালা, শিল্পীরানী, ছবিরানী, বিন্দুরানী, মলি¬কারানী সহ অনেকেই।

পলিবালা কলেজে পড়ছেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বড়ি তৈরি করেন। বিদ্যালয়ে পড়ার দিন গুলো খুব কষ্টে কেটেছে তার। তখন প্রায়ই তাকে না খেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হতো। এখন দিন বদলেছে। পড়াশোনার খরচ তো চলছেই, বড়ি থেকে আয়ের টাকা তিনি সংসারে দিচ্ছেন। একই ভাবে বড়ি তৈরি করে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছে দিপালী রানী, ববিতা রানী, মায়ারানী সহ অনেকে।

যেভাবে যায় দূর-দূরান্তে: রূপসী গ্রামে বড়ি কিনতে আসা পাইকার হরিপদ ভুলু ও মোবারক হোসেন বলেন, রাজধানী ঢাকা এবং উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জেলায় বড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের শহরে বন্দরে ছড়িয়ে পড়ে রূপগঞ্জের বড়ি। রূপসী বাজারের বড়ি বিক্রেতা সালাউদ্দিন, ইকবাল, মুড়াপাড়া বাজারের সুবল চন্দ্র ও কায়েতপাড়া বাজারের আনোয়ার হোসেন বলেন, মাষকলাইয়ের তৈরি বড়ি, কৈ মাছ, পুটি মাছ, মাংস, ফুলকপি, আলু, লাউ সহ সবধরনের ব্যাঞ্জনে মানুষ খুব মজা করে খায়। হাট বাজারে এ বড়ি নিয়ে গেলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কাঞ্চন বাজারের ব্যবসায়ী খলিল সিকদার বলেন, বড়ির চাহিদা সবসময়। তবে শীতকালে বেশি। তারাব পৌরসভার মেয়র হাসিনা গাজী বলেন, বজ্রবালা গ্রামের নারীদের যেভাবে জীবিকার পথ দেখালেন, তা অন্য এলাকার অভাবী নারীদের জন্য একটি ভালো উদাহরণ।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত