ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

ইত্তেফাক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:৫০

ইত্তেফাক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির এক দলীয় একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের প্রথম এবং শেষ অধিবেশন শুরু হয় ১৯ মার্চ। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটসহ বিরোধী দলীয় অন্যান্য সকল জোট ও দলের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন তুঙ্গে। দেশব্যাপী চলছে অসহযোগ আন্দোলন। তার উপর সংসদ অবরোধের কর্মসূচি। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার। নিয়মিত সংসদ অধিবেশনের সংবাদ সংগ্রহ করি। সেদিনও আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সংসদে। বাসা থেকে বের হলাম সংসদে যাওয়ার জন্য। রাজপথে হাজার হাজার মানুষ। মিছিল, বিক্ষোভ, সমাবেশ চলছে। কোনোমতে হেঁটে সংসদে গিয়ে হাজির হলাম। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাস সংসদে এলেন। সদস্যদের অধিকাংশই আগে থেকেই সংসদে অবস্থান করেন। উদ্বোধনী দিনে প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। এদিকে আওয়ামী লীগ ধানমন্ডির রাসেল স্কোয়ার ও ২৭ নম্বর রোড এলাকায় সমাবেশের আয়োজন করে। অধিবেশন যখন চলছে তখন ধানমন্ডির আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে বিরাট মিছিল সংসদ ভবনের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পুলিশ বেপরোয়া গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। মিছিলকারীরাও পাল্টা বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। পুরো ধানমন্ডি এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দোকান পাট ও পেট্রোল পাম্পে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এদিকে রাতে শেখ হাসিনার ৫ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনের বেডরুম লক্ষ্য করে লেকের ওপার থেকে কে বা কারা গুলি ছুঁড়ে। এতে পরদিন রাজধানীতে আন্দোলন আরও চাঙ্গা হয়।

২৪ মার্চ ’৯৬ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে বিকাল ৪টায়। এরমধ্যেই সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পেশ করা হয়। বিএনপি নেতৃবৃন্দ এবং তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আগে বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা তথা বিরোধীদের মূল দাবি নাকচ করে দেন। সংবিধানে নেই বলে এ নিয়ে কথাও বলতে চাননি। আর বিরোধীরা বারবার বলেছে, ‘সংবিধানে নেই বলেই আমরা দাবি উত্থাপন করছি। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংসদে বিল আনতে বলছি।’ কিন্তু বিএনপি এতে রাজি হয়নি। এমনকি প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শব্দটি মুখেও আনতে চায়নি। সেই বিএনপি নিজেরাই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপন করল। ২৪ মার্চই এ বিল পাস হবে। বাইরের অবস্থা নাজুক। সারাদেশে আগুন জ্বলছে। তাই আর দেরি নয়। যদিও বিরোধীরা বলছে অবৈধ সংসদে পাস করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল তারা মেনে নেবেন না। তবুও পর্দার অন্তরালে কিছু একটা সমঝোতার আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল। বিএনপি সংসদে বিল পাস করে ক্ষমতাত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নতুন নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দিলে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীরা তা মেনে নেবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকরা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করে এ ধরনের একটি আপস-সমঝোতা করেছে বলে জানা যায়। যে কারণে বিএনপির সেদিনই বিল পাস করা ছাড়া উপায় ছিল না।

মাগরিবের নামাজের পর সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিলটি তাড়াহুড়ো করে আনায় অনেক ত্রুটি ছিল, তাই একের পর এক সংশোধনী আসে। এমনিতেই সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের প্রক্রিয়া খুবই জটিল। ভোটাভুটি হতে হয়, তাও কয়েক দফা ভোট। রাত ১২টা পর্যন্ত খুঁটিনাটি আলোচনায়ই কেটে যায়। বিল পাস হবে জানি, কিন্তু পাস না হওয়া পর্যন্ত রিপোর্টও পাঠানো যাবে না। আর বিলম্বে রিপোর্ট পাঠালে ছাপাও সম্ভব নয়। আমি তত্কালীন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে (বর্তমানে সমকাল সম্পাদক) যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তুমি এ পর্যন্ত যা হয়েছে পাঠাও। প্রয়োজনে দ্বিতীয় সংস্করণ বের করব। এরমধ্যেই পত্রিকার ডামি হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাপা শুরু হবে।’

সংসদে সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার আমীর খসরু (বর্তমানে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি)। তাঁকে প্রেস গ্যালারিতে রেখে আমি তাড়াহুড়া করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল নিয়ে সংসদে আলোচনার তাত্ক্ষণিক পর্যায়ে একটি রিপোর্ট ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দিই। তখন সংসদ থেকে কম্পিউটারে রিপোর্ট পাঠানোর সুযোগ ছিল না। ফ্যাক্সই ছিল একমাত্র ভরসা। অথবা অফিসে গিয়ে লেখা। এ রিপোর্ট দিয়েই কাগজ ছাপা শুরু হয়। সারওয়ার ভাই আগেই বলেছিলেন তিনি অফিসে থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন হাসান শাহরিয়ার ভাই। শাহরিয়ার ভাই তখন ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা। বর্তমানে কমনওয়েলথ জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনে এমিরেটস্ প্রেসিডেন্ট। নির্দেশ ছিল তাদের যেন আপটুডেট খবর পাঠাই। রাত দু’টায়ও সংশোধনী আলোচনা চলছিল। আমি তাদের খবর দিলাম বিল পাস হতে ভোর হয়ে যাবে। এ খবর শুনে তারা দুজনেই কাকরাইলে হোটেলে চলে যান। তখন কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলে আমরা ইত্তেফাকের কজন রাতে থাকতাম। হরতাল-অবরোধে বাসা থেকে অফিসে আসা যাওয়ার সমস্যার কারণেই এ ব্যবস্থা ছিল। সংসদে আমি আর খসরু প্রেস গ্যালারিতে। আরও সাংবাদিক আছেন। সবাই চিন্তা করছেন কী করবেন। খসরুর সঙ্গে আমিও পরামর্শ করি কী করা যায়। যদি অন্য কাগজে বিল পাসের খবর ছাপা হয় আর ইত্তেফাকে ছাপা না হয় তাহলে বেইজ্জতির শেষ থাকবে না। তবে ইত্তেফাকের মতো সমস্যা অন্য সব কাগজের নেই। ইত্তেফাক তখন দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক। ছাপা হয় তখনকার অন্যান্য কাগজের চাইতে অনেক বেশি। তাই আগে ভাগে কাজ শেষ করতে হয়। অন্য কাগজে ভোর রাতে ছাপা শুরু করলেও কোনো অসুবিধাও হয় না। আবার অফিসে টেলিফোন করলাম। সারওয়ার ভাই আর শাহরিয়ার ভাই ততক্ষণে হোটেলে চলে গেছেন। শিফট ইনচার্জ আছেন। বলে গেছেন প্রয়োজন হলে যেন হোটেলে যোগাযোগ করি। আমি হোটেলে টেলিফোন করে সারওয়ার ভাইকে পেলাম রাত ৩টায়। তাঁকে জানালাম বেশির ভাগ কাগজের সাংবাদিক সংসদে আছেন। অনেকে হয়তো নগর সংস্করণ বের করে হলেও নিউজ দিবে সঙ্গে সঙ্গে। তখন বিশেষ জরুরি খবর ছাড়া দ্বিতীয় সংস্করণ হতো না। সারওয়ার ভাই বললেন, আমি অফিসে যাচ্ছি তোমরা সংসদে থাকো। যে করেই হোক সময়মতো খবর পাঠাতে হবে। আমি খসরুকে এসে বিস্তারিত জানালাম।

রাত সাড়ে ৩টা। দুপুরে যা খেয়েছি, এরপর চা ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। এতক্ষণ টেনশনে খাবারের কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু এখন বেশ ক্ষুধা অনুভব হচ্ছিল। খসরুকে বললাম, কী করা যায়। কেন্টিনের খাবার আগেই শেষ। চাও নেই। তাই ট্যাপের পানি খাওয়াই সার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলের উপর আলোচনা চলছে তো চলছেই। ভোর রাতে কোন দফায় কী আলোচনা হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিল না। সদস্যরাও অনেকে ছিলেন বিভ্রান্তির মধ্যে, কোন শব্দের বদল কোন শব্দ বসবে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। আলোচনা শেষ হলে বিভক্তি ভোটের পালা। তখন রাত সোয়া ৪টা। বিভক্তি ভোট জটিল প্রক্রিয়া। সদস্যদের বাইরে যেতে হলো। সেখানে খাতায় স্বাক্ষর করে আবার কক্ষে ফিরে এলেন। পরে সংসদ কর্মচারীরা খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর স্পিকারকে অবহিত করলে স্পিকারের ঘোষণা আসবে। বিভক্তি ভোটের সামগ্রিক প্রক্রিয়া শেষে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ভোর ৫টা ২০ মিনিটে ঘোষণা করেন যে, ২৫৮-০ শূন্য ভোটে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের বিল পাস হয়েছে।

স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাসের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে চলে যাই স্পিকারের পিএস হেমায়েত সাহেবের কক্ষে। তখন কিন্তু এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। একটিমাত্র কোম্পানি উচ্চ মূল্যে মোবাইল ফোন বিক্রি করত। রিপোর্টারদের পক্ষে এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব ছিল না। ল্যান্ড ফোনই ভরসা ছিল। তাই টেলিফোন ব্যবহারের জন্য স্পিকারের পিএসের কক্ষে যাওয়া আসা। সেখান থেকে টেলিফোন করি অফিসে। সারওয়ার ভাই সঙ্গে সঙ্গে ধরলেন। বললাম বিল পাস হয়েছে। সারওয়ার ভাইকে সময়টা, পক্ষ-বিপক্ষ ভোট সংখ্যা ও বিলে কী কী আছে সংক্ষেপে বললে তিনি নিজেই লিখে নিলেন। এ খবর দিতে দিতেই শুনি প্রধানমন্ত্রী সমাপনী ভাষণ দিতে উঠেছেন। পিএস-এর কক্ষেই মাইক্রোফোন ছিল, তাই আমি ভাষণ শুনছিলাম। তখনো সারওয়ার ভাই লাইনে আছেন। আমি জানাই প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছেন। আমি এখান থেকেই মাইক্রোফোনে শুনছি। সারওয়ার ভাই বললেন, শুনে শুনে তুমি বল আমি লিখছি। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণদানের সময় সংসদ ভবনে ও বাইরে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি সংসদ কক্ষেও ভেসে আসে। এ ভাবে সেদিন সংসদ থেকে নিউজ পাঠিয়ে খসরুকে নিয়ে অফিসে ফিরি ভোর ৬টায়। গিয়ে দেখি সারওয়ার ভাই ও শাহরিয়ার ভাই আইটেম তৈরি করে ফেলেছেন। সারওয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে পরে শুনেছি তিনি এসে দেখেন কম্পিউটার অপারেটর নেই, গ্রাফিক্স ডিজাইনার নেই। সবাইকে বাসা থেকে আবার অফিসে আনিয়েছেন। সকাল সোয়া ৬টার মধ্যে প্রেসে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য মেকআপ দিয়ে পৌনে ৭টায় আমরা অফিস থেকে কাগজ নিয়ে হোটেলে ফিরি। এর মধ্যে প্রথম সংস্করণ ছাপা ও বিতরণ প্রায় শেষ হয়েছে। প্রেস অপেক্ষা করছিল। আমরা তখন অন্য সব কাগজ নিয়ে বসি। দেখি অনেক কাগজেই তত্ত্বাধায়ক সরকারের বিল পাসের খবরটি নেই। আমরা তরতাজা খবরটি দিতে পেরেছি। এতেই তৃপ্তি। এটা সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা ও প্রস্তুতির জন্যই।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটার বিহীন নির্বাচিত সংসদের একটিমাত্র অধিবেশন বসেছিল। মাত্র ১৫ দিনের অধিবেশনের একমাত্র কার্যক্রম ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস। দেশের এই ষষ্ঠ সংসদের স্পিকার ছিলেন শেখ রাজ্জাক আলী। আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। আইনমন্ত্রী বিলটি উপস্থাপন করেন। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার কারণে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম হয়। সেই বিএনপিই সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশ জার্নাল

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত