বিশ্বকাপের আড়ালে রমরমা সেক্স ট্যুরিজম ও মানব পাচার!
সার্জিন শরীফ
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০১৮, ১৬:১৪ আপডেট : ২০ জুন ২০১৮, ১২:৫৬
সম্প্রতি নাইজেরিয়ায় ফিফার 'ফ্যান পাস' পাওয়া দশ শিশুকে মানব পাচারকারী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। ওই শিশুদের মধ্যে নয়জনই ছিল মেয়ে। নাইজেরিয়ার মুরতালা মুহাম্মেদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে একুমখী টিকিটে রাশিয়ায় যাওয়ার সময় তাদের পথরোধ করে দেশটির মানব পাচার বিরোধী সংস্থা। গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচ সন্দেহভাজন পাচারকারীকে। যাদের মধ্যে ছিল পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর একজন করে সদস্য।
বিশ্বজুড়ে মানব পাচার এক বড় আতঙ্কের নাম। মার্কিন সরকারের এক হিসাবে বলা হয়, প্রতিবছর ছয় থেকে আট লাখ মানুষ পাচারের শিকার হন। আর বিশ্বজনীন যেমন ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের মতো অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই হার বেড়ে যায় বহুগুণে।
অন্যদিকে, ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় দেশটিতে ভ্রমণ করেন ছয় লাখেরও বিদেশি। যাদের শতকরা ৭৫ ভাগই পুরুষ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উৎসব চলাকালীন সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঘুরতে যান আয়োজক দেশটিতে। আর মানব পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্লগার মিশেল লিলির মতে, যেখানেই ট্যুরিজম সেখানেই রয়েছে 'সেক্স ট্যুরিজম'।
বিশ্বের অনেক দেশের মতোই ব্রাজিলেও যৌনতা বিষয়ক আইন একইরকম। ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউই চাইলে যৌনতা বিনিময় করতে পারেন। তবে গণিকালয় পরিচালনা কিংবা দালালি আইনগতভাবে সেখানে নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনের এই বাধ্যবাধকতা যৌনতার জন্য মানব পাচার রোধ করতে পারেনি। ২০১৪ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ অলিম্পিকের সময়ে দেশটিতে যৌনব্যবসা বেড়ে যায় বহুগুণে। খদ্দেরদের 'চাহিদা' মেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দশ-এগারো বছরের শিশুদের পাচার করা হয় ব্রাজিলে। পাচার হওয়া ওইসব শিশুদের বেশিরভাগকেই আনা হয় দরিদ্র দেশগুলো থেকে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম মিররের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় ব্রাজিলের উদ্বাস্তু এক নারীর কথা। জানা যায়, সাত বছর বয়স থেকে উদ্বাস্তু অবস্থায় বাস করে আসছেন তিনি। ওই নারীর ভাষায়, 'স্থানীয় লোকজন এবং পর্যটকদের জন্য চরম ঝুঁকির মুখে থাকতে হয় পথশিশুদের। নেশার ঘোরে কিংবা আরও নেশার জন্য অর্থ জোগাতে তারা পর্যটকদের বিছানায় যায়। মূলতঃ যৌন হেনস্তার ব্যথা দূর করতেই তারা নেশায় ডুবে থাকতে চায়। আর এভাবেই নেশার টাকা যোগাতে প্রতিনিয়ত নিজেদের বিক্রি করে তারা।'
২০১৪ বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলের রিও শহরে যৌন ব্যবসা এবং মানব পাচার বিরোধী প্রচারণায় নামেন ভ্যাটিকান ন্যানরা। তাদের করা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে যৌন ব্যবসা বেড়ে যায় ৩০ শতাংশ। আর ২০১০ থেকে ২০১৪ বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে।
ফিফা এবং মানব পাচার:
ফুটবল পাগল পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতেও মানব পাচার একটি পুরনো সমস্যা। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে পাচার করে স্থানীয় চক্রগুলো। মাত্র তিন হাজার ইউরো 'ফি'র মাধ্যমেই ইউরোপের যে কোনো বড় ক্লাবে সুযোগ করে দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয় তাদের। ওই অর্থের মধ্যে থাকে তাদের ভিসা, পাসপোর্ট আর বিমানের ভাড়াও।
জাতিসংঘ মনে করে ফুটবলের যশ, অর্থ এবং প্রতিভা অন্বেষণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী মানব পাচার পেয়েছে নতুন একটি মাত্রা। অনেক অননুমোদিত ফুটবল অ্যাকাডেমির কাজই হল ইউরোপ কিংবা আরবের দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এইসব দালালদের কাজ হল পাচার হওয়া শিশুদের ফের পাচার করে দেওয়া।
কূটনীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট ফরেন পলিসি জানায়, পশ্চিম আফ্রিকান দেশ যেমন- নাইজেরিয়া, ঘানা এবং সেনেগালের মতো দেশের ফুটবল ক্লাব থেকে ইউরোপে যাওয়ার পর কার্যত অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে ফুটবলাররা। দালালরা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় আর ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে ইউরোপ যাওয়া কিশোরেরা বিদেশের মাটিতে হয়ে পড়ে সমাজচ্যুত। তাই বাধ্য হয়েই তারা অপরাধ জগতকে বেছে নেয় জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে।
এ বিষয়ে অবশ্য ফুটবলের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার পক্ষ থেকে দেখা যায়নি তেমন কোনো পদক্ষেপ। ২০০১ সালে প্রণীত ধারা ১৯ এ কেবল ১৮ বছরের কমবয়েসী কাউকে ফুটবলের জন্য দেশান্তর করার নিষেধাজ্ঞা জারি করে সংস্থাটি। তবে এক্ষেত্রে ইউরোপের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ইউরোপীয়ান দেশগুলোর মধ্যে ১৬ বছর বয়সী যে কেউ ফুটবল খেলার জন্য অন্য দেশে মাইগ্রেশন করতে পারবে।
কিন্তু এই আইনটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ এবং অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়ই খেলতে আসে। কিন্তু এই আইনের ফলে সম্ভাবনাময় অনেক কিশোর-তরুণই উপযুক্ত সময়ে ভাল ক্লাবে যোগ দিতে পারে না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম বড় ক্লাব চেলসির বিরুদ্ধে আবার আছে এই আইন ভাঙার অভিযোগ।
গত বছর মস্কোতে অনুষ্ঠিত কনফেডারেশন কাপ উপলক্ষে বিনা ভিসায় রাশিয়ায় যাওয়ার অনুমতি দেয় দেশটির সরকার। যে অনুমোদনের কার্যকারিতা রয়েছে চলতি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। রাশিয়ার দাসপ্রথাবিরোধী সংগঠন অল্টারনেটিভার মুখপাত্র জুলিয়া সিলইউয়ানোভার মতে, রুশ সরকারের এই ভিসা নীতি পাচারকারীদের জন্য একটি 'উপহার'। কারণ অন্যান্য সময়ে মানবপাচার সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হলেও এখন তা হয়ে গেছে অনেক সহজ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাল বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নাইজেরিয়া থেকে বিভিন্ন বয়সের নারীদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে যৌনদাসী হিসেবে। পাচারের শিকার হওয়া অনেককেই এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে রাশিয়ায় দেখার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন এই মানবাধিকারকর্মী।
গত ১৪ জুন রাশিয়া এবং সৌদি আরবের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। আগামী ১৫ জুলাই একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল খেলা। এছাড়া দেশটির আরও দশটি শহরে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসএস