ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪০ মিনিট আগে
শিরোনাম

যাই কন তাই কন, তাসকিন আইকন

  মাহমুদুল হক

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০১৮, ২১:১৩

যাই কন তাই কন, তাসকিন আইকন

রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল সমুদ্র আমি সাঁতরে পাড়ি দেবো এত বড় দুঃসাহস হয়নি। তবে দুই একবার সমুদ্র ভ্রমণে যাইনি এমন নয়। তাই রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই আজ শুরু করতে চাই।

রবী বাবু বলেছেন- ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা’।

নৃবিজ্ঞান পড়তে এসেও আমি জেনেছি চলতি পথে কোনো ঘটনাই তুচ্ছ নয়। এর মাঝেই হয়তো মানুষের গূঢ় আচরণ লুকিয়ে আছে। আজ তাই লেখার শিরোণাম দেখেই আঁচ করতে পারছেন সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় তাসকিন আহমেদের ফেসবুকে স্ট্যাটাস নিয়ে সৃষ্ট আলোচনা হবে।

তাসকিনের গল্প বলার আগে নিজের জীবনের খুব ছোটবেলার একটি গল্প আজ ভীষণ মনে পড়ছে। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে প্রায়ই তর্কে জড়াতাম। একদিন তুমুল তর্ক চলছে; একবন্ধু ম্যারাডোনাকে নিয়ে অকাট্য সব যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় হুট করে একজন বলে বসলো- ‘আরে তোর ম্যারাডোনাতো মেয়েদের সাথে চাকুম-চুকুম করে, ও আবার সেরা হয় ক্যামনে?’ এ প্রশ্নের উত্তর সেই কিশোর বন্ধুটি দিতে না পেরে মূক হয়ে ছিল। আজ বড় বেলায় এসেও চারদিকে এমন সব ঘটনা ঘটছে যার উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

সম্প্রতি একজন জাতীয় ক্রিকেটার পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন। এমন খবরে সাধারণত লোকে খুশিই হয়। কিন্তু এ বিষয়টি একেবারে উল্টো। লোকে যেন আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কি আক্রোশ, কেন আক্রোশ? প্রশ্ন একটাই বিয়ের একবছর যেতে না যেতেই সন্তান কোথা থেকে এলো? এমন প্রশ্ন হরহামেশাই শোনা যায়- ওমুক নায়িকা কেন কালো ছেলে বিয়ে করলো? তমুক লেখক কেন হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করলো? এমন আলোচিত ব্যক্তির ডিভোর্স কেন হবে? সমাজের এমন হাজারো প্রশ্নে সমাজই জর্জরিত।

হয়তো কখনোই এর উত্তর কেউ পায় না। তবুও কেন এমন প্রশ্ন?

একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে এ সমস্যার গভীরে কতগুলো কারণ খুঁজে পাই। ১) আমরা ভুলে যাই আমাদের অবস্থান। ২) ভারতীয় উপমহাদেশে আইকন পূজো। ৩) নারীর প্রতি অসম্মান। ৪) নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা। ৫) তথ্যের বাহুল্য।

এ দেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের চেয়ে এ তালিকা হয়তো দীর্ঘতর হবে। তবে, আপাতত এই কয়টি বিষয় নিয়ে এগুনো যাক।

যে দেশে চারিত্রিক সনদ স্বাক্ষর করেন একজন ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান, সে দেশে অবস্থানের যে কোনো বালাই নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা ভুলেই যাই আমাদের অবস্থান। আমার সাথে একজন ব্যক্তির কি সম্পর্ক আমরা কখনো ভেবেই দেখি না।

সমালোচনায় এতটাই মগ্ন হয়তো ভাবার ফুরসতই পাই না। কখনো চিন্তাই করি না একজন লেখকের সাথে আমার কেবলই লেখক-পাঠক সম্পর্ক। তার ব্যক্তি জীবনের সাথে আমার কোনো সম্পর্কই নেই। তিনি লেখেন, আমি পাঠ করি। একজন নায়িকা অভিনয় করেন আমি অভিনয় দেখে মুগ্ধ হই। একজন খেলোয়াড় ভালো খেলেন আমি তার খেলা দেখে আন্দোলিত হই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমি হয়ে উঠি লেখক, অভিনেতা, খেলোয়াড়ের অভিভাবক। কোথায় পেলাম এ অভিভাবকত্ব? কে আমাকে অভিভাবকের আসনে বসালো? কেউ জানি না।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন একজন নামিদামি ব্যক্তি চাইলেই এমন করতে পারেন না। কারণ তাকে অনেকে ফলো করেন। তিনি একজন আইকন। ভারতীয় উপমহাদেশে এই আইকন পূজো খুব চলে। আমরা খুব অল্পতেই কাউকে আইকন, ভগবান, ঈশ্বর এর আসনে বসিয়ে ফেলি। পরক্ষণেই নিজ স্বার্থ রক্ষা না হলে বলি- ‘খোদার কোনো বিচার নাই’।

খেলায় হারলেই খেলোয়াড়কে, সিনেমা ফ্লপ করলেই অভিনেতাকে, নিজের বিরুদ্ধে লিখলেই লেখককে তুলোধুনো করতে এক মুহূর্তও দেরি করি না। কারণ আমাদের কাছে আইকন মানেই ভগবান, তিনি আর মানুষ নন, তিনি কোনো পাপ করতে পারেন না। প্রতিভা তখন অভিশাপ হয়ে ধরা দেয়। জীবন হয়ে উঠে সমাজের হাতের জয়স্টিক। সমাজের ইচ্ছার বাইরে যেন কিছুই করার সুযোগ নেই। আর তাইতো বিপত্তি শুধু এক বছরের মধ্যে সন্তান জন্মদানই নয়, তাকে ঘিরে দেয়া স্ট্যাটাসেও। একজন আইকন খেলোয়াড় কেন সমাজের এসব ’ফালতু’ মানুষের উত্তর দিতে যাবেন? যাই কন তাই কন, তাসকিন আইকন তার তো এমন গা ভাসানো উচিৎ না? তার স্ট্যাটাসে কেন বানান ভুল হবে?

উত্তর না দিয়েও কি সমাজে বেঁচে থাকার জো আছে? যেভাবে একজন নারীকে নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে টিকে থাকাই মুশকিল একজন স্বামীর। প্রতিনিয়ত আমরা নারীকে অসম্মান করে চলেছি। দোষ কিন্তু পুরুষের থাকছে না। বিষয়টি এমন যে, যে নারী বিয়ের আগেই গর্ভধারণ করে সে আর যাই হোক ভালো হতে পারে না (অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন গর্ভ ভাড়া দেয়া হয়/কিংবা সিঙ্গেল মাদার প্রচলিত)। মোদ্দাকথা হচ্ছে যেহেতু তিনি একজন আইকন খেলোয়াড় তাই তিনি এমন একজন খারাপ মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন না। অর্থাৎ দোষ হলো সেই কুলটা নারীর।

এই নারীকেই বার বার সীতার মতো অগ্নীপরীক্ষা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। এ তো গেল একদিক। অপরদিকে সমাজে আমাদের স্ব স্ব স্বত্বার প্রমাণ দিতেও কম পিছিয়ে নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখনই কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে অংশগ্রহণ অবশ্যই চাই। নইলে সমাজে যে আমি টিকে আছি তার প্রমাণ মিলল কই? আর তাই ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যাই হোক না কেন কমেন্ট করে আলোচনায় অংশগ্রহণ থাকা চাই। শত অপবাদেও কোনো কিছু না বললে বলব- ব্যাটার ঘাপলা আছে, নইলে কিছু বলে নাই কেনো? আবার গাণিতিক হিসাবের পরে বলব- এতকিছু আপনার তো বলার দরকার নেই। উত্তরের তোয়াক্কা না করে হয়তো কেবল নিজের অবস্থান জানান দেয়ার জন্যই এই অযাচিত আলোচনায় অংশগ্রহণ।

এই যে অত্যধিক আলোচনা এ আলোচনার একটা বড় কারণ হলো- তথ্যের বাহুল্য। সমাজে যেকোনো তথ্য এখন অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের কাছে। এই খবরগুলোর মাঝে হয়তো খুব কম খবরই আছে যা আদতে খবর হয়ে উঠার দাবি রাখে। অথচ কার ডিভোর্স হলো, কার ঘরে অন্নপ্রাসন, কে দুই কেজি মেদ কমালো এমন খবরে পত্রিকা সয়লাব। কিছুদিন আগে দেখলাম জীবন্ত মানুষকে মেরে ফেলা হলো। পরে দেখা গেল সে অভিনেতা লাইভে এসে জানান দিল তিনি বেঁচে আছেন। কোন খবর শেয়ার দেয়া উচিৎ আর কোন খবর এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ সেই পরিমিতি বোধ হয়তো আমাদের এখনো আসেনি। আর তাই এক ধরনের ‘কালচারাল ল্যাগ’ দেখা দিয়েছে। নিজের কাজ বাদ দিয়ে আমরা তাই অন্যের সমালোচনায় মত্ত।

শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে তাই তারই একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরা, অন্য নাম অতশী, যেদিন মারা যায় সেদিনও তিনি রাতে সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিংবা প্রিয়তমা স্ত্রী মৃণালিনী মারা যাওয়ার পর কবি কষ্ট পেয়েছেন বটে তবু নিজের কাজ থেকে ছুটি নেননি, বন্ধ করেননি শান্তিনিকেতনের কাজ অথবা লেখালেখি। আপনমনে করে গেছেন সাহিত্য সাধনা। বাংলায় তাই একটি কথা আছে- নিজের চরকায় তেল দাও।

লেখক: প্রভাষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বাবদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পঠিত