ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

পেঁয়াজের ঝাঁজ, ডেঙ্গু আতঙ্ক

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:১০  
আপডেট :
 ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:২০

পেঁয়াজের ঝাঁজ, ডেঙ্গু আতঙ্ক

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে দলটি। মন্ত্রিসভায়ও আনা হয় চমক। কিন্তু চমকের সঙ্গে সঙ্গেও ঘটে চলে নানা রকমের বিপত্তি। একদিকে যেমনি পেঁয়াজের আকাশ ছোঁয়া দাম জনগণকে করে তোলে অখুশি। তেমনি বছরজুড়ে সারাদেশ ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম হয়ে দেখা দেয়।

সর্বশেষ পেঁয়াজকাণ্ডে সাধারণের নাভিশ্বাস- পদত্যাগের দাবিও ওঠে টিপু মুনশির বিরুদ্ধে। তা-ই শেষ হতে যাওয়া ‘২০১৯ সাল’ বেশ অস্বস্তির মধ্যে কাটে বাণিজ্যমন্ত্রীর।

সর্বশেষ পেঁয়াজের ঝাঁজ নিয়ন্ত্রণে যেন নিরঙ্কুশ পরাজয়ের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী। দাম কম ও সহজ পরিবহনের কারণে সাধারণত প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তবে এ বছর ভারতের মহারাষ্ট্র ও অন্য এলাকায় বন্যার কারণে পেঁয়াজের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত প্রতি টন পেঁয়াজের মিনিমাম এক্সপোর্ট প্রাইস (এমইপি) নির্ধারণ করে দেয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। দেশের বাজারে হু-হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম।

দফায় দফায় দাম বেড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারে সবচেয়ে বেশি দামের পণ্যের তালিকায় সবার ওপরে স্থান করে নেয় পেঁয়াজ। পেঁয়াজের দাম ২৫০ থেকে ২৭০ টাকায় পৌঁছায়। এ অবস্থায় দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে জরুরিভিত্তিতে কার্গো বিমানে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশে পেঁয়াজ বিক্রি কার্যক্রম বাড়ানো হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।

পরবর্তীতে দেশজুড়ে বাজারে বাজারে অভিযান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস, বড় চালান আসার খবর—কোনো কিছুই থামাতে পারেনি না পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি। শেষ ভরসা হিসেবে দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন দিশেহারা ক্রেতারা। অবশেষে পেঁয়াজ আসে বাজারে, কিছুটা স্বস্তি মেলে ঝাঁজে।

এদিকে পেঁয়াজ নিয়ে সিন্ডিকেটে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটের খবর বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর তথ্য দেয়, ভারত, মিয়ানমার, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা গড়ে মাত্র ৩৮ টাকায় পেঁয়াজ আমদানি করে সেগুলো দেশের বাজারে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের জোর দাবি ওঠে। অবশ্য বাজার নিয়ন্ত্রণে তার কোনো গাফিলতি ছিল না বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে যুক্তি দেখান টিপু মুনশি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারেননি তিনি।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বলেছেন, যেসব মন্ত্রী দায়িত্বপালনে ব্যর্থ, তাদের বাদ দেয়া হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। খুব শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদে রদবদলের আভাসও দেন তিনি। তবে পরবর্তীতে সম্মেলনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস নয় বলে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের। এখন দেখার বিষয় চমক নিয়ে মন্ত্রিসভায় আসা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী টিপু মুনশি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে থাকছেন, না বিদায় নিচ্ছেন।

ডেঙ্গু​ আতঙ্ক: অন্যদিকে অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে সেখান থেকে সংসদে গেলেও বাজেট প্রস্তাব পুরো পড়তে পারলেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল; কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে বললেন, ‘শত্রুরও যেন ডেঙ্গু না হয়।’ ডেঙ্গুর ব্যাপকতায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও অসুস্থ সন্তানকে ভর্তি করতে পারেননি অনেক বাবা-মা। বড় দুঃসময়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পিআইসিইউর একটা সিট মেলাতে না পারায় প্রাণ গেছে একটি ছোট্ট মেয়ের, যদিও তার চিকিৎসার জন্য বাবা-মায়ের টাকার অভাব ছিল না। বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর ভয়ংকর বিস্তারের মধ্যে স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে বেড়াতে এসে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইতালি প্রবাসী এক নারী।

ঢাকায় ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন নওগাঁর এক বৃদ্ধ দম্পতি। জ্বর হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই মারা যান বাবা, তাকে হারানোর শোক না কাটতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে যেতে হয় মাকে। তাদের মতো কেউ স্বজনকে দেখতে এসে, কেউ আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে আবার কেউ একদিনের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে এসেও ডেঙ্গুর জীবাণু শরীরে নিয়ে যান।

ডেঙ্গুর চাপে সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হয় ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ, ওয়ার্ডগুলোর মেঝে ছাপিয়ে বারান্দা এমনকি লিফটের সামনের খোলা জায়গায়ও কোনো রকম বিছানা ফেলে চিকিৎসা নিতে হয়। অনেক অপেক্ষা ও অনুরোধের পরেও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে চিকিৎসার জন্যই অনেককে ছুটতে হয়েছে ঢাকার বাইরে।

এই যখন পরিস্থিতি সে সময় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ব্যবহূত ওষুধের কার্যকারিতা না থাকার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে সৃষ্টি হয় আরেক আলোচনা।

আক্রান্তে রেকর্ড: আক্রান্ত কিংবা মৃতের সংখ্যা বা রোগের ভয়াবহতা, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু এসেছে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে ৬৪ জেলায়। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। আর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৪৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, যদিও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশ’র বেশি মানুষের এই রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার হিসেবে এ বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৯৩৩ জন। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা ২৬৬টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১৪৮ জনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে তারা। এর আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ২০০০ সালে, ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়, আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৫৫১ জন।

২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে সরকারের খাতায়। সেখানে এ বছরের আগস্টেই আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন। বিগত বছরগুলোয় ডেঙ্গু ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এ বছর ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে। এবার গ্রামাঞ্চলেও পাওয়া গেছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা।

এরমধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫১ হাজার ৭৬২ জন, রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলায় রোগী পাওয়া গেছে প্রায় সমপরিমাণ, ৪৯ হাজার ৫১১ জন। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ৯৭১ জন, সবচেয়ে কম সিলেটে ১ হাজার ১১ জন।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত