ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

শোকস্তব্ধ বড়লেখার সেই চা বাগান

  মৌলভীবাজার প্রতিনিধি :

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২০, ১৪:১৬

শোকস্তব্ধ বড়লেখার সেই চা বাগান

কাজে মন নেই শ্রমিকদের। চায়ের ফ্যাক্টরিও বন্ধ। চা শ্রমিক পরিবারের লোকজনদের চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছায়া। এরকম ঘটনা আগে কখনোই দেখেননি পাল্লাথল চা বাগানের শ্রমিকরা। এই নৃশংস ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় সকলেই বাকরুদ্ধ।

বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন নারী চা শ্রমিকরা। সবার আলোচনার বিষয় সেদিনের নৃশংসতা। অনাকাঙ্খিত একটি ঘটনা সকলকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তরতাজা মানুষগুলোর মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা।

বড়লেখা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাল্লাথল চা বাগানে রোববার ভোরে যে নৃশংস ঘটনাটি ঘটে গেলো সোমবারও তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউ। বাগানের ফ্যাক্টরি বাবু অঞ্জন দাস সেই ঘটনা মনে করে এখনও কাঁদছেন। কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারছিলেন না তিনি।

পাল্লাথল চা বাগানের অঞ্জন দাস জানালেন, প্রায় ১৮ বছর ধরে এই বাগানে চাকরি করেন। বাগানের শ্রমিকরা তার পরিবারের সদস্যদের মত হয়ে গেছে। রক্তের সম্পর্কের না হলেও শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যের মত দেখেন। এই অবস্থায় একসঙ্গে পাঁচজনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন অঞ্জন দাস।

রবিবার ভোরে পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী, শাশুড়ি এবং দুই প্রতিবেশীকে কুপিয়ে হত্যা করেন নির্মল কর্মকার (৩৮) নামের এক ব্যক্তি। এরপর ঘরের তীরের সঙ্গে রশিতে ঝুলে সে নিজেই আত্মহত্যা করেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার পাল্লাথল চা-বাগানে এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটে। এতে নির্মলের হাতে খুন হন তার স্ত্রী জলি বুনার্জি (৩০), শাশুড়ি লক্ষ্মী বুনার্জি (৬০), প্রতিবেশী বসন্ত বক্তা (৬০) এবং বসন্ত বক্তার মেয়ে শিউলী বক্তা (১৪)। হামলায় বসন্ত বক্তার স্ত্রী কানন বক্তাও গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পাঁচটি আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনার শোক অঞ্জন দাসের মতো এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেননি পাল্লাথল চা-বাগানের শ্রমিকরাও। সোমবার কাজের দিন হলেও বাগানে ছিলো না কোনো প্রাণচাঞ্চল্য। গোটা বাগান জুড়ে ছিল শোকের ছায়া।

অঞ্জনের ঘরের পাশে তার ছেলে অর্নবের সাথে খেলছিল ঘটনার সময় বেঁচে যাওয়া শিশু কন্যা চন্দনা বুনার্জি (৯)। অর্নব তার সহপাঠী। একসাথে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। এই মেয়টি অনেক আগেই বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। এরই মধ্যে হারিয়েছে মাকে। এখনও কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সে। সব হারিয়ে তার আশ্রয় হয়েছে অঞ্জনের ঘরে। অঞ্জন জানালেন, মেয়টি এখন কোথাও যেতে চাইছে না। আমার পরিবারের সাথে থাকবে।

কথা হয় এলাকার বাসিন্দা সমাজসেবক ফারুক আহমদের সাথে। তিনি বলেন, ‘দুপর থেকে বিকালের সময়টা বাগানে খুব হৈ-হুল্লোড় থাকে। কিন্তু আজ বাগানে এমনটি নেই। শোকে গাছের পাতাও যেন নড়ছে না। ৩০ থেকে ৩৫ বছর বাগানের লোকজনের সাথে ওঠা-বসা। এরকম নীরব নিস্তব্ধ পাল্লাথল বাগান আর কোনোদিন ছিল না। কেউ দেখেনি।’

বাগানের ফ্যাক্টরির সামনে কথা হয় পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি কার্তিক কর্মকারের সাথে। তিনি বলেন, ‘হত্যাকান্ডের এই ঘটনাটিতে সবাই মর্মাহত। সোমবার বাগানের কাজের দিন। কিন্তু ঠিকমত কেউ কাজে যোগ দেয়নি। শোকেস্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই। অনেকের ঘরে রান্নাবান্না হয়নি। কেউ এই ঘটনাটি ভুলতে পারছে না।’

বাগানের চা ফ্যাক্টরির সামনে কথা হয় স্থানীয় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটনের সাথে। তিনি বলেন, ‘বাগানের মানুষের সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক। এই ঘটনায় সবার সাথে আমরাও মর্মাহত। বাগানের আজ (সোমবার)কাজের দিনেও সব নিস্তব্ধ। সবার চোখেমুখে বিষন্নতা। এরকম পাল্লাথল বাগান কোনোদিন দেখিনি। শ্রমিকরা সব সময় হাসি-খুশিতে থাকত। একটি ঘটনায় সকলকে হতবাক করেছে।’

চেয়ারম্যান আরো বলেন, স্বজন হারানো তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী চন্দনার লেখাপড়াসহ ভরণ পোষণের দায়িত্ব আমি নেব। তার কেউ নেই। এখন এই বাচ্চটার খেয়াল রাখা আমাদের দরকার।

এদিকে সোমবার বিকেলে বড়লেখার পাল্লাথল চা বাগানের ঘটনাস্থলটি পরিদর্শন করেছেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান। এসময় তার সাথে ছিলেন মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, সিলেটের সহকারী পুলিশ সুপার (রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়) গৌতম দেব, বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিনুল হক, উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন প্রমুখ।

ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, একই সাথে পাঁচজন মানুষের মৃত্যু, খুবই মর্মান্তিক একটি ঘটনা। এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিহত জলি বুনার্জির মেয়ে চন্দনা বুনার্জির ব্যাপারে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সে যাতে শিক্ষিত ও ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠতে পারে এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ এমএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত