ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

নেত্রকোনায় পৌর মার্কেট দ্রুত পুনঃস্থাপন চান ব্যবসায়ীরা

  নেত্রকোনা প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:২২  
আপডেট :
 ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:২৯

নেত্রকোনায় পৌর মার্কেট দ্রুত পুনঃস্থাপন চান ব্যবসায়ীরা

নেত্রকোনা পৌরসভার মার্কেটটি দ্রুত পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নোটিশ দেয়ার পর নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০১৮ সালের ১৪ মে একরকম জোর করেই ওই মার্কেটের প্রায় ২০ জন ব্যবসায়ীকে বের করে দেয় পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।

এ সময় স্থানীয় কমিশনার হেলালের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের ওপর এক ধরনের মানসিক নির্যাতনও করে কতিপয় বখাটে। খোদ হেলাল কমিশনার সেদিন মার্কেট সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম আজাদকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র আলহাজ নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘কাউকে জোর করে উঠিয়ে দেয়া হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবসায়ীদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। এরপর তারা নিজেরাই জরাজীর্ণ মার্কেটটি থেকে তাদের মালপত্র সরিয়ে নিয়েছেন।’

জানা যায়, ১৯৮৯ সালে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন সুপার মার্কেটটি নির্মাণ করে। এরপর সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা লিজ নিয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে পৌরসভার উন্নয়নের জন্য নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মার্কেটটি পরিচালনার দায়িত্ব পৌরসভার ওপর ছেড়ে দেন। এরপর থেকে ব্যবসায়ীরা পৌরসভাকে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এ অবস্থায় ২০১২ সালে তৎকালীন পৌর মেয়র প্রশান্ত কুমার রায় ২২ বছরের ভবনটিকে জরাজীর্ণ ঘোষণা দিয়ে উন্নয়নের কথা বলে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের এক মাসের মধ্যে দোকান ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেন।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আসলে উন্নয়ন নয়, পৌরসভা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান ইজারাদারদের সরিয়ে সেখানে ক্ষমতাসীন নতুন গ্রাহকদের আরও উচ্চমূল্যে ও পুরনোদের মধ্যে যারা উচ্চমূল্য দিতে পারবে তাদের নতুন করে লিজ দেয়া।

মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আরো জানান, বিষয়টি মেয়রের সঙ্গে বসে সুরাহার জন্য বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারা। এরপর অসহায় ব্যবসায়ীরা কোনও উপায় না পেয়ে উচ্চ আদালতে যান। পৌরসভা কর্তৃপক্ষও উচ্চ আদালতে যান। কিন্তু আদালত পৌরসভার মামলাটি খারিজ করে দেন।

তখন সরকারিভাবে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য কোনও বাজেট না এলেও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতকে মিথ্যা তথ্য দেন। তারা আদালতকে জানান, নতুন মার্কেট নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এরপর আদালত উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবসায়ীদের মার্কেট ছেড়ে দিতে বলেন। সেইসঙ্গে পৌরসভাকে নির্দেশ দেন ভবন নির্মিত হলে নিচের ফ্লোরটি পূর্বে লিজ নেয়া ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দিতে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে না নিতে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আরেকটি নোটিশ দেয়। নোটিশে বলা হয় উচ্চ আদালত ব্যবসায়ীদের করা মামলাটি অকার্যকর ঘোষণা করেছে। এরপর ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ফের আদালতের শরণাপন্ন হন।

এদিকে ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নেত্রকোনা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হন আলহাজ নজরুল ইসলাম খান। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি পৌর মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় ব্যবসায়ীরা বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করে দেবেন এবং মামলা তুলে নেবেন। নতুন করে চারশ টাকার জায়গায় আটশ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ব্যবসায়ীরা পৌরসভা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। সেইসঙ্গে মামলার তদারকি থেকে সরে আসেন তারা। এরপর ২০১৮ সালের মার্চের শেষের দিকে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আরেকটি নোটিশ দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবসায়ীদের ঘর ছাড়ার নির্দেশ দেন। এরপর ব্যবসায়ীরা ফের হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, হাইকোর্ট তাদের ওই মার্কেটে ব্যবসা করার অনুমতি দেন। এর মধ্যে ১০১৮ সালের ১৪ মে হেলাল কমিশনারের নেতৃত্বে বখাটেরা ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করে মালপত্র সরানোর সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বের করে দেন।

গেল বছরের ৭ এপ্রিল লিপি হক নামের একজন ইজারাদার আরেকটি মামলা করেন মার্কেটটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ চেয়ে। কিন্তু এর মধ্যেই ভাঙা মার্কেটটিতে অন্য লোকজনকে ঢুকানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।

মামলার বাদী লিপি হক বলেন, এই মার্কেটটির সঙ্গে আমাদের রুটি-রুজিই নয় আবেগও জড়িয়ে আছে। আমরা দীর্ঘদিন এই মার্কেটে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছি। অনেক গরীব ব্যবসায়ী এখান থেকে উচ্ছেদের পর অসহায় জীবন-যাপন করেছে। দুজন ব্যবসায়ী হঠাৎ উচ্ছেদের শোক সইতে না পেরে মারা গেছেন। আমরা দ্রুত মার্কেটটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাই।

মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমি পৌর মার্কেটটিতে ১৯৯১ সাল থেকে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের জেলা এজেন্ট ছিলাম। হঠাৎ ভাংচুর করে সরিয়ে দেয়ায় খুবই মানবেতর জীবন-যাবন করছি। আমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। তারা দুজনেই মেধাবী। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্য না থাকার কারণে তাদের পড়াশোনা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা দ্রুত মার্কেটের পজিশন ফেরত চাই।

পৌর মার্কেটটিতে দীর্ঘদিন ধরে ছাপাখানার ব্যবসা করতেন বিনন্দ চন্দ্র সাহা রায়। তিনি বলেন, হঠাৎ উচ্ছেদ করে দেয়ার কারণে আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পৌর মার্কেটটি থেকে চলে আসার পর ব্যবসাও ভালো হচ্ছে না। মার্কেটটিতে যেন আমাদেরকে আবার ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হয় মেয়রের প্রতি এই অনুরোধ জানাই।

মার্কেটটির মনোহারি ব্যবসায়ী দীপক সাহা বলেন, অতর্কিতভাবে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বের করে দিয়েছে। আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। নতুন দোকানে আর আগের মতো ক্রেতারা আসেন না। স্বাভাবিকভাবে বকেয়া টাকাগুলোও তুলতে পারিনি। আসলে উন্নয়ন নয়, মার্কেটটি থেকে আমাদের চিরতরে সরিয়ে দিয়ে অন্য লোকদের ঢুকানোর জন্যই টালবাহানা করছে কর্তৃপক্ষ।

মার্কেটটির ব্যবসায়ী সামসুল হক বলেন, হেলাল কমিশনার ভাঙা মার্কেটটিতে অন্য লোকদের ঢুকানোর চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে সুজন ও মোশারফ হোসেন নামের দুই ফল ব্যবসায়ীকে ঢুকানো হয়েছে মার্কেটটিতে। আমরা বৈধ ইজারাদার হিসেবে মার্কেটের পজিশন চাই।

অভিযোগ অস্বীকার করে কমিশনার মোহাম্মদ হেলালুর রহমান বলেন, আপনারা সরজমিনে এসে দেখতে পারেন মার্কেটটিতে কোনো ফলের দোকান নেই। ভাঙার সময় আমি কারো সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহারও করিনি।

পৌর মার্কেটের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম আজাদ বলেন, হেলাল কমিশনার কিছু সুইপারকে মদপান করিয়ে অতর্কিতভাবে মার্কেটটি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করেন। মার্কেটটির সভাপতি হিসেবে আমি এর প্রতিবাদ করলে-হেলাল কমিশনার বলেন, তুই মুক্তিযোদ্ধা না হলে তোকে আমি উলঙ্গ করে শহর ঘুরাতাম।

মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের এই অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হেলাল কমিশনার বলেন, আমি এরকম কোনও কথা বলিনি। মার্কেটটিতো আমার বাবার নয়। আমি একজন জনপ্রতিনিধি। আমি কেন মানুষকে গালাগালি করতে যাব।

বিষয়টি সম্পর্কে সাবেক মেয়র ও বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে মার্কেটটির উন্নয়ন ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। তারা আমার সঙ্গে আলোচনা না করে মামলা করে দিয়েছিলেন। আদালত তাদের মামলা খারিজ করে দেন। আসলে তারা পৌরসভার স্বার্থ না দেখে নিজের স্বার্থ দেখেন। তারা এই পৌর মার্কেটটিকে নিজেদের সম্পদ মনে করেন। যে কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন বিষয়টি তো বর্তমান মেয়র দেখবেন।

তবে ব্যবসায়ীদের সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বর্তমান মেয়র আলহাজ নজরুল ইসলাম খান বলেন, মার্কেট থেকে কাউকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়নি। নোটিশ দেয়ার পর তারা স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। নতুন ভবন তৈরি হলে আইনানুগভাবে পূর্বে যারা ছিল, তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সবক্ষেত্রেই তা হয়ে থাকে। এ নিয়ে আমার আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি নেই। সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে কাজ করাই আমার লক্ষ্য।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত