ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১২ মিনিট আগে
শিরোনাম

যৌন কেলেঙ্কারিতে জেলে মাদ্রাসা সুপার, প্রশাসনিক কাজে চরম স্থবিরতা

  মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:১৯  
আপডেট :
 ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:২৬

যৌন কেলেঙ্কারিতে জেলে মাদ্রাসা সুপার, প্রশাসনিক কাজে চরম স্থবিরতা

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জালালিয়া দাখিল মাদ্রাসা ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলি ফুলতলী (রঃ) ও বিশকুটি (রঃ) এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তি লাভ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সন্তোষজনক ফলাফল অর্জন করলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে নেমে এসেছে অন্ধকারের ছায়া। অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি (মেয়াদোত্তীর্ণ) ও সুপারের একচ্ছত্র ক্ষমতার দাপটে প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীর সাথে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় এক মাস ধরে মাদ্রাসা সুপার মো. আব্দুস শহীদ জেলহাজতে রয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্বে কেউ না থাকায় মাদ্রাসায় বর্তমানে প্রশাসনিক কাজ বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও স্থগিত কমিটির সভাপতির কারণে নতুন কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসারের ওপর অনাস্থা এনে নির্বাচন স্থগিত চেয়ে দুই অভিভাবক আব্দুল হান্নান ও মখলিছ মিয়া গত বছরের ১৪ জুলাই হাইকোর্টে একটি পিটিশন (নং-৮৭৩০) করেন। এদিকে অভিভাবক মো. আব্দুল হান্নানের ছেলে মোস্তাফিজ হোসেন রাহিম নামে শিক্ষার্থী কুলাউড়ার কামারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র বলে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রে জানা গেছে। কিন্তু সেই রাহিমকে জালালীয়া মাদ্রাসার ছাত্র দেখিয়ে তার পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করানো হয়।

মাদ্রাসার বর্তমান কমিটি ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। বিধি মোতাবেক নতুন কমিটি গঠনে প্রশাসনের কোন আদেশ কার্যকর হচ্ছে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার বারবার মাদ্রাসা সুপারকে পত্র ইস্যুর মাধ্যমে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি গঠনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেও সুপার তাতে কর্ণপাত করেননি। একদিকে সুপার জেলহাজতে থাকায় নতুন ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব না পাওয়া এবং নতুন কমিটি না থাকায় প্রশাসনিক কাজে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন মাদ্রাসার সুপার মাও. আব্দুস শহীদ। এরই প্রেক্ষিতে ইউএনও পরবর্তীতে ১৭ জুন শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রিজাইডিং অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে অনুরোধ জানালেও সুপার শহীদ প্রিজাইডিং অফিসারকে কোনো তথ্য দেননি। ১ জুলাই সুপার শহীদ বোর্ড কর্তৃক কমিটি অনুমোদনের একটি কপি প্রদান করলেও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করেন নি। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য না পেয়ে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে পারেন নি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। পরবর্তীতে নির্বাচনের তফসিল কেন ঘোষণা হলো না মর্মে ইউএনও ফের ১১ জুলাই পত্র ইস্যুর মাধ্যমে সুপারকে অনুরোধ করেন। তাতেও সাড়া দেননি সুপার শহীদ। কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মাধ্যমে ক্ষমতার দাপট খাঁটিয়ে সুপার আব্দুস শহীদকে দিয়েই সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদ্রাসা পরিচালনা করেন। কমিটি না থাকায় প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাঘাতের অভিযোগ এনে ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্থানীয় এলাকার ৩০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন ও মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষিকা ও কর্মচারিবৃন্দ আরেকটি আবেদন করেন। আবেদনে কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এডহক কমিটি গঠন এবং বর্তমান সহকারি সুপার মাও. মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়।

এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সদস্য বাবুল মিয়া মুঠোফোনে বলেন “আমাকে ফোনে জানানো হয়, আমি মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। আমাকে কমিটির সভায় কোনদিন ডাকাও হয়নি। তাছাড়া কার্যনির্বাহী সভায় রেজ্যুলেশন বহিতে আমি কোনদিন স্বাক্ষরও করিনি।”

মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির (মেয়াদোত্তীর্ণ) সভাপতি কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফের খবরদারির কারণে শিক্ষকরা নানাভাবে হয়রানি হচ্ছেন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আটকে থাকায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। একপর্যায়ে গত বছরের ৩১ অক্টোবর বেতন-ভাতা উত্তোলনের জন্য মাদ্রাসার শিক্ষকরা ইউএনও বরাবর আবেদন করেন। পরে ইউএনও’র মাধ্যমেই তারা তাদের বেতন-ভাতা তোলছেন। অন্যদিকে আব্দুর রউফের শিক্ষক আব্দুস সামাদ মাদ্রাসা প্রশাসনিক ভবনের চাবি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহকারি সুপারকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। এতে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাদ্রাসার সুপার আব্দুস শহীদ কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার দশম শ্রেণীর ছাত্রীর বাবা গত বছরের ১৯ আগস্ট মৌলভীবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে মামলা (নং-২৮৮/১৯ইং) দায়ের করলে মামলাটি আদালত পিবিআই কে তদন্তের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ তদন্তের পর পিবিআই অভিযুক্ত সুপার আব্দুস শহীদকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। এরই প্রেক্ষিতে আদালত ৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করায় সুপার আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান।

এ ব্যাপারে মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির (মেয়াদোত্তীর্ণ) সভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা আ.লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ বলেন, মাদ্রাসায় শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এদিকে আপনার দ্বারা মাদ্রাসার বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে ও সুপার জেলহাজতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম থাকলে সেখানে আইন আছে। মাদ্রাসায় কোনো অনিয়ম হয়নি, আর সুপার কোথায় আছেন জানি না। তবে সুপার আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন। বর্তমানে মাদ্রাসার প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য আমি মানুষ ঠিক করে দিয়েছি। মাদ্রাসার কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। এক স্কুলের ছাত্রকে মাদ্রাসায় ভর্তি দেখিয়ে তার পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে পিটিশন কিভাবে করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন সবাই জানেনা, একজনের পক্ষে আরেকজন পিটিশন করতেই পারে। মাদ্রাসার পরিবেশ নষ্ট করার জন্য একটি মহল এসব ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আনোয়ার বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি আজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে মাদ্রাসা সুপারের অসহযোগিতার কারণে কমিটি গঠনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। আর ভারপ্রাপ্ত সুপারের বিষয়ে ইউএনও মহোদয় একটি নির্দেশনা দিবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, মাদ্রাসায় কমিটি না থাকায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের কোনো নির্দেশনা পাইনি। শুধু আমার স্বাক্ষরে পরিপত্রের আলোকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচন বিষয়ে মহামান্য আদালতের নির্দেশনা পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত