ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

প্রশাসন নীরব

বনদস্যুদের দাপটে বিরাণভূমির পথে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য

  হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:৪১  
আপডেট :
 ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৪০

বনদস্যুদের দাপটে বিরাণভূমির পথে অভয়ারণ্য

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে প্রকাশ্যেই চলছে গাছ পাচারের মহোৎসব। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে কাটা গাছ উদ্ধার ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিলেও নিয়ন্ত্রণ হয়নি গাছ পাচার। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে গাছ কাটার ফলে বিরাণভূমিতে পরিণত হওয়ার পথে দেশের বৃহত্তম এই বনভূমি। কর্তৃপক্ষ বলছে- আগে গাছ কাটা হলেও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া গাছ পাচার রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা।

জানা যায়, রেমা-কালেঙ্গা একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন, যা সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি। ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে সেগুন, মেহগনি, আকাশীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। কিন্তু প্রতিনিয়ত সেখান থেকে গাছ পাচারের কারণে একদিকে যেমন বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে বৃহত্তম এই বনাঞ্চলটি, তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। আর আবাসন হারিয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী।

সরেজমিনে বনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বনভূমি থেকে গাছ কেটে ট্রাক্টর লোড করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও বনের ভেতর থেকে গাছ এনে ট্রাক-ট্রাক্টরের লোড করা হচ্ছে। তবে তাদের দাবি, তারা গাছ কাটার সাথে সম্পৃক্ত না। ৪শ’ টাকা দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে তারা গাছ কাটছেন।

বনের আরও ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কাটা গাছের শত শত গুঁড়ি দাড়িয়ে রয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে গাছের ছোট-ছোট ডালপালাও। বেশ কয়েক স্থানে অনেকটা দাপটের সাথে গাছ কাটছেন বনদস্যুরা। সাংবাদিক দেখে অনেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেও কেউ কেউ আবার বীরদর্পে গাছ কাটা অব্যহত রেখেছেন। এমনকি গাছ কাটার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলেও বিষয়টি যেন তাদের গায়েই লাগেনি।

গাছ কেন কাটছেন তা জানতে চাইলে অনেকে কথা বলতে রাজি হননি। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, সরকারি বনাঞ্চল থেকে নয়, নিজেদের খাস জমি থেকে এসব গাছ কাটা হচ্ছে। তারা বলেন, রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল থেকে দিনের বেলা কোন গাছ কাটা হয় না। বনদস্যুরা রাতের আঁধারে বড় বড় গাছ কেটে নেয়।

স্থানীয়রা দাবি করেন, দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই বনাঞ্চল থেকে কাটা হচ্ছে মহামূল্যবান সব গাছ। বিশেষ করে সেগুন, মেহগনি, আকাশী গাছগুলোতেই বেশি থাবা পড়েছে বনদস্যুদের। বনাঞ্চলে থাকা এসব মহামূল্যবান গাছ এখন অধিকাংশই নিধন হয়ে গেছে। আর এর যোগসাজস রয়েছে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮২ সালে বনটিকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ১৯৯৬ সালে এ বনের সম্প্রসারণ করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় গাছ কাটা। একসময় এই বনে ৫শ’ প্রজাতির গাছ থাকলেও, অব্যহতভাবে নিধনের কারণে এখন অনেক প্রজাতির গাছই বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মূলত সিন্ডিকটের মাধ্যমে গাছ কাটা হয়েছে গত ২৪ বছর ধরে।

নুহ বাহিনীর প্রধান নুহ, হোসেন বাহিনীর প্রধান হোসেন ও মনা মিয়াসহ স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই চক্রের নিয়ন্ত্রণ করেন। বনের অংশ ভাগ করে বন থেকে গাছ কাটার চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক গাছ পাচারের মামলাও রয়েছে চুনারুঘাট থানায়। অনেকবার জেলও খেটেছেন এইসব প্রভাবশালী বনদস্যু। বর্তমানেও তারা গাছ পাচার মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তবে বন্ধ থাকেনি বন থেকে গাছ পাচারের মহোৎসব। তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা নিয়ন্ত্রণ করছেন চক্রগুলোকে।

আহমেদ আলী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘রেমা-কালেঙ্গা থেকে দিনে-দুপুরে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। অথচ বন বিভাগের নাকের ডগায় গাছ পাচার হলেও তারা কিছু করছে না। মাঝে মধ্যে ছোট-খাট পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েও অধিকাংশ পাচারকারীই বুক ফুলিয়ে বন থেকে গাছ পাচার করছেন।’

রেমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন- ‘দীর্ঘদিন ধরে এই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই ট্রাক অথবা ট্রাক্টরে করে প্রকাশ্যে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই রেমার প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।’

তনি বলেন, ‘অব্যহতভাবে গাছ কাটার কারণে বনাঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে বন্যাপ্রাণীও কমে যাচ্ছে, যা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকিসরূপ।’

গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘পূর্বে রেমা-কালেঙ্গা বন বিট থেকে প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা হয়েছে। বলতে গেলে এখন আর তেমন গাছপালা নাই। যার কারণে এখন আর গাছ কাটা হয় না। তবে এখনও কিছু গাছ কাটা হচ্ছে। এগুলোর জন্য প্রশাসনকে আরও সতর্ক হতে হবে।’

রেমা-কালেঙ্গা বন বিটের রেঞ্জ অফিসার মো. আলাউদ্দিন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন- ‘আমি এই বিটে যোগদানের পর থেকে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। বনদস্যু নুহ ও হোসেনসহ একাধিক দস্যুদের আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তারা বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছেন। এই বন থেকে কোনো গাছ পাচার হয় না। আমরা সার্বক্ষণিক বনের চারপাশ নিয়মিত টহলসহ পর্যবেক্ষণ করছি।’

চুনারুঘাট বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক মো. মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি। বন থেকে গাছ পাচার হয়, এ বিষয়টি জানা নেই। তবে বেশকিছু মামলা রয়েছে। আগামীতে আমরা আরও সতর্ক হব।’

এদিকে, অনেক পাচারকারী দাবি করছিলেন, সরকারি বনভূমি থেকে নয়, তারা নিজেদের খাস জায়গা থেকে গাছ কাটছেন। তবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ি সরকারি খাস জায়গা থেকে গাছ কাটলেও জেলা বা উপজেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়।

তারা এ ব্যাপারে অনুমতি নিয়েছেন কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, ‘আমাদেও কাছ থেকে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি।’ এ ব্যাপারে এর বেশি কথা বলতে তিনি রাজি হননি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত