ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী চা কন্যারা

  হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২০, ২১:২৬  
আপডেট :
 ০৮ মার্চ ২০২০, ২১:৩৭

শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী চা কন্যারা

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার লালচাঁন চা বাগানের নারী চা শ্রমিক কানু বালা। বয়স এখন ৫০ ছুঁই ছুঁই। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। এরপর থেকেই নামতে হয় জীবন সংগ্রামের যুদ্ধে। দীর্ঘ ৩ যুগেরও অধিক সময় ধরে একাই টেনে যাচ্ছেন সংসার নামের সেই কঠিন ঘানি। এখনও মেলেনি তার মুক্তি। স্বামী আর চার সন্তানের বেঁচে থাকা যেন এই সংগ্রামী নারীর ওপরই নির্ভর করছে।

ছোট দুই ছেলে-মেয়ে পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিকে। বাকি এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী আর বড় ছেলে চা বাগানেই স্বল্প মজুরিতে বিভিন্ন ধরণের কাজ করেন। তাও নিয়মিত নয়। মাসের অধিকাংশ দিনই তাদের বেকার থাকতে হয়। ফলে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া ও সংসারের ভরন-পোষণ নির্ভর করে কানু বালার ওপরেই। চা বাগানে অল্প মজুরিতে কাজ করার টাকা দিয়েই নিজের মতো করে অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছেন ৬ সদস্যেও এই পরিবারটিকে।

শুধু কানু বালাই নয়, চা বাগানের অধিকাংশ নারী শ্রমিকই এমন সংগ্রামী। যে বয়সটি লেখাপড়া আর দুরন্তপনায় কাটানোর কথা, সেই বয়সেই লাল শাড়ি পড়ে যেতে হয় স্বামীর ঘরে। এরপরও থেকেই শুরু হয় জীবন নামের কঠিন যুদ্ধ। সংসার সামলানো, চা বাগানে পাতা উত্তোলন, এরপর আবার সন্তানের লালন-পালন। কিশোর বয়স থেকে সবই একা সামলাতে হয় নারী চা শ্রমিকদের।

নারী নেত্রীদের মতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংগ্রামী নারী হচ্ছেন চা কন্যারা। কিশোরী বয়স থেকেই জীবন নামের কঠিন সংগ্রামে নামতে হয় তাদের। অধিকাংশ চা শ্রমিক কন্যাদের বিয়ে হয় ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে। এরপর থেকেই তাদের ধরতে হয় পুরো সংসারের হাল। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর গোছানো ও রান্না-বান্না করতে হয় তাদের। এরপর নিজে খেয়ে না খেয়েই দৌড়ে ছুটতে হয় বাগানে। সারাদিন পাতা সংগ্রহ শেষে বাড়ি ফিরে আবারও সাংসারিক কাজ। পুরো সংসারের কাজ শেষে সন্তানের লালন-পালনও তাদেরকেই করতে হয় কিশোর বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত।

এদিকে, চা বাগানের অধিকাংশ পুরুষই মদ্যপ। অসচেতন নারী চা শ্রমিকদের সইতে হয় নেশাগ্রস্থ স্বামীদের শারিরীক ও মানষিক নির্যাতন। কিন্তু এরপরও কোন প্রতিবাদ না করে নিরবেই মুখ বুঝে সব সহ্য করে যান তারা। জীবনের সব প্রতিকূলতাকেই জয় করে বেঁচে থাকতে হয় এই নারীদের।

কানু বালার কাছে তার জীবন সংগ্রামের বিষয়ে জানতে চাইলে চেহারায় একটুও কষ্টের চাপ না ফেলে হাসিমুখেই বললেন, ‘হামরা বালা আছি, সুখত আছি।’

তিনি জানান, স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক সুখে আছেন। বাগানে কাজ করে যে মজুরি ও রেশন পান তা দিয়েই কোনকরমে দিন চলে যাচ্ছে। তবে তিনি মজুরি আরও বাড়ানোর দাবি করেন। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার। এর জন্য সরকারের সহযোগিতা চান তিনি।

একই উপজেলার চাকলাপুঞ্জি বাগানের বানুমতি মুণ্ডা জানান, ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পর থেকে বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। স্বামীও একই বাগানে পাহাড়ানদার হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু স্বামী যে বেতন পান তা দিয়ে তার নেশার টাকাই হয় না। তাই সম্পূর্ণ পরিবারটি নিজেই চালাচ্ছে দীর্ঘ কয়েক যুক ধরে।

রেমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি রেমা চা বাগানের এই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। আমি স্কুলে আসার আগেই তারা বাগানে এসে পাতা সংগ্রহ শুরু করেন। একেবারে সন্ধ্যা হলে বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে উত্তোলিত পাতা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরেন। এরপরও আবার সংসার ও সন্তানদের সামলাতে হয়।’

তিনি বলেন, আমি মাঝে-মধ্যে অবাক হই। একজন নারী হয়ে এতো কিছু করেন কিভাবে তারা।

নারী নেত্রী তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, আমার মতে চা শ্রমিক কন্যাদের মতো অন্য কোন নারী পরিশ্রম করতে পারবেন না। শিক্ষা-দিক্ষা না থাকার পরও তারা অল্প টাকায় যেভাবে বড় বড় পরিবার পরিচালনা করেন, তা অবাক করার মতো। আমার মতে চা কন্যারা শ্রেষ্ট সংগ্রামী নারী। ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত পরিবার সামলানো, ভরণ-পোষণ করা আবার সন্তান লানপালন করা, সবই একা করতে হয় তাদের।

তিনি বলেন, কিশোরী বয়স থেকে তাদের জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। কিন্তু কষ্টের বিষয় হলো এতো সংগ্রামী হওয়ার পরও তারা ন্যায্য অধিকার পান না। সমাজে তাদের মূল্যায়নই নেই। তাদের খোঁজ-খবর নেয়ারও সময় নেই কারও।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত