ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

শুধু একটি জেলা নয়, অনুভূতির নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া

  নাজমুল হোসেন ও ইমরুল নূর

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২০, ২২:৫৫  
আপডেট :
 ১৯ এপ্রিল ২০২০, ১৫:৪৭

শুধু একটি জেলা নয়, অনুভূতির নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া

বাংলাদেশের যে অঞ্চলসমূহ সংগীত, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা অন্যতম। এই জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বললে বোধ হয় বেশি বলা হবে না। তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংগীত, শিল্প সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির তীর্থ ক্ষেত্র রূপে ভারতীয় উপমহাদেশে সুপরিচিত একটি জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গানের দেশ গুনীর দেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেন জ্ঞানী-গুনীর খনি স্বরূপ। অসংখ্য জ্ঞানী-গুনীর বিভিন্ন অবদানের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপমহাদেশব্যাপী ও বিশ্বব্যাপী আজ পরিচিত। শুধু একটি জেলা নয়, অনুভূতির নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

মেঘনা-তিতাসের পলি মাটির আবাহনে বাঁধা এ ভূখন্ড লোক সংস্কৃতির দিক থেকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। সামাজিক ও ভূ-প্রকৃতির বিন্যাস, নদ-নদী ও জলবায়ুর প্রভাব, জনবসতির ধরন, লোকসমাজের আচার বিশ্বাস, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য এবং নিরন্তর, পরিবর্তনশীল মানসিক পরিমন্ডলের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে এখানকার বিচিত্র বহুমাত্রিক এবং অভ্যন্তরীণ গতিশীলতায় সমৃদ্ধ লোক সংস্কৃতি। বস্তুধর্মী ও সাহিত্যধর্মী উভয় শ্রেণীর লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ঐশ্বর্যশালী। তিতাস নদী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তিতাস অববাহিকায় কিংবা পলি কাদায় জন্মগ্রহণ করেছে বিশ্ববিখ্যাত অনেক কৃতী সন্তান। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ থেকে শুরু করে শচীন দেব বর্মন ও সুবল দাস পর্যন্ত সুরের যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তা এখন সৈয়দ আব্দুল হাদীর মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সুদৃঢ় ভিত্তিমূলের উপর প্রতিষ্ঠিত।

অপরদিকে এই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম। মোগল আমলে নির্মিত সরাইলের আরফাইলের মসজিদ ও হাতিরপুল, কালভৈরব মন্দির, খড়মপুরের কেল্লাশাহ মাজার, নবী নগরের সতীদাহ মন্দির, বাঁশীহাতে শিবমূর্তি, সাধক মনমোহনের আনন্দ আশ্রম, হাছান শাহ মাজার, কসবার কৈলাঘর দূর্গ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামালের কবর এ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মরণ করে দেয়। এ জেলার ছানামুখী মিষ্টি, বিলম্বী ফল। বিলম্ব যা সারাদেশে পাওয়া মুসকিল। মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, যাত্রা, তিতাসে নৌকাবাইচ, পুতুল নাচ, সরাইলের মোরগের লড়াই সারা দেশজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশে সেন বংশের রাজত্বকালে কোনো অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবার এ অঞ্চলে ছিল না। এতে পূজা অনুষ্ঠানে বেশ অসুবিধার সৃষ্টি হত। রাজা লক্ষণ সেন কারো মতে আদিশূর কান্যকুঞ্জ থেকে বেশ কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার আনয়ন করেন। সেই ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশধরদের এক পরিবার বসতি স্থাপন করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌলভী পাড়া নামক স্থানে। এই প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়ি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি। অপর এক মতে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্ব থেকে বৃহত্তর ত্রিপুরায় হিন্দুদের আধিক্য ছিল। আর সেই সময় এক অত্যাচারী ব্রাহ্মণ্যবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই অত্যাচারী ব্রাহ্মণের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষার জন্য গাজী মাহমুদ শাহ (রাঃ) নামে এক ইসলামী বুজুর্গ ব্যক্তির আগমন ঘটে। তিনি অত্যাচারী ব্রাহ্মণদের এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘ব্রাহ্মণ বের হয়ে যাও' আদেশ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

নদ-নদী, হাওড়-বাওর এবং চিরশ্যামলীমার দেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, গাছপালার সবুজে ঢাকা গ্রাম, রাখালের মেঠো সুর আর মাঝির কণ্ঠে ভাইয়ালি গান। নাসিরনগর থেকে বাঞ্চারামপুর আবহমান নিসর্গের পরিচিত দেশ। মেরাসানী, হরষপুর, আজমপুরের পাহাড়ী লাল মাটিতে প্রকৃতির এক ভিন্ন বৈচিত্র্য। সরাইল ও কসবায় আদি বসতির অনেক স্থাপত্য, তিতাসের রূপ সুধায় মুগ্ধ আখাউড়া-নবীনগর, মেঘনার তীরে বাণিজ্য বসতি আশুগঞ্জ; ঐশ্বর্যে সংস্কৃতিতে রত্ন গর্ভা নবীনগর। আনাদি অপত্যস্নেহে তিতাস চিরকাল ঘিরে রেখেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে। প্রকৃতি তার অঢেল উপঢৌকনে, সহায়ে সম্পদে অমরাবতী করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পূর্বে বৃহৎ কুমিল্লা তারও পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। ১৮৬৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা সৃষ্টি হয়। ১৮৩০ সালের পূর্বে সরাইল পরগনা মোমেনশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ৯টি উপজেলা, ২টি প্রস্তাবিত থানা, ৪টি পৌরসভা, ৯৮টি ইউনিয়ন, ১০৫২টি মৌজা এবং ১ হাজার ৩৭৫টি গ্রাম নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা।

জেলার প্রধান নদী তিতাস ও মেঘনা। উপনদী ও শাখা নদী-আউলিয়া জুড়ি, ডোল ভাঙ্গা, পাগলা, বুড়ী, কালাছড়া, ছিনাইহানি, বলভদ্র, বালুয়া, বিজনা, রোপা, লংঘন, লহুর, সোনাই, হাওড়া প্রভৃতি। জেলা মেহেদী ও আকাশি প্রধান হাওর। জেলার উল্লেখযোগ্য দীঘি হচ্ছে সাগরদীঘি, কল্যাণীদীঘি, শোকসাগর দীঘি, গঙ্গাসাগর দীঘি, ধর্ম দীঘি, রাজার দীঘি, ফসলা দীঘি।

জেলার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ২শ' ৮০ হেক্টর, পতিত জমি ৭শ' হেক্টর, এক ফসলি ২৮ দশমিক ৩৮ ভাগ দো-ফসলি ৫৩ দশমিক ৯৫ ভাগ, তিন ফসলি ১৭ দশমিক ৬৭ ভাগ। সেচের আওতায় আবাদি জমি ৫৫ দশমিক ৩১ ভাগ। ভূমিহীন ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আবাদি জমি ০.০৭ হেক্টর। জেলায় অন্যান্য জেলার মতো কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। জেলায় মৎস্য খামার ৬৪টি, গবাদি পশু ৬১, হাঁস-মুরগি ৮৩, হ্যাচারি ৪৩, নার্সারি ১৭ ইত্যাদি। জেলার মোট বনাঞ্চলের পরিমাণ ৪ হাজার ৪শ' ৮৫ একর।

জেলার আশুগঞ্জে সার কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। জেলার কয়েক শতাব্দী ধরে তাঁত বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। উনবিংশ শতাব্দীতে সরাইলে তানজেব নামক বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র তৈরি হতো।

বৃটিশ আমল থেকে রাধিকার বেতের টুপি তৈরি হচ্ছে। জেলার চম্পকনগরে নৌকা তৈরি হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিখ্যাত। জেলার তিনটি গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। এ তিনটি গ্যাস ফিল্ড হচ্ছে- তিতাস, মেঘনা ও সালদা নদী গ্যাস ফিল্ড। বলতে গেলে দেশের অন্যতম চালিকা শক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্যাস। জেলার ১৯৮৫ সালেই গড়ে উঠেছে বিসিক শিল্পনগরী।

জেলার শিক্ষার হার ৫২ দশমিক ৩ ভাগ। জেলায় রয়েছে সরকারি কলেজ ২টি। বেসরকারি কলেজ ৩৯টি, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৭টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৪৪টি, মাদরাসা ১২৪টি, মক্তব ২ হাজার ৩১৪টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৯০টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩২৩টি, পিটিআই ১টি, ল'কলেজ ১টি, নার্সিং ইন্সটিটিউট ১টি, মুক-বধির বিদ্যালয় ১টি, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ২টি, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ১টি সংগীত স্কুল ২টি, হোমিও কলেজ ১টি ইত্যাদি।

জেলায় হাসপাতাল রয়েছে ৩১টি, টিবি ক্লিনিক ১টি, কমিউনিটি ক্লিনিক ২৪৩টি, বেসরকারি ক্লিনিক ১৮টি, পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ৭টি। জেলার পশু-পাখি কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ২৪টি। এছাড়াও জেলায় রয়েছে ১২০টি বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা। ডাকঘর আছে ১৫২টি।

আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিল্প, সাহিত্য এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। উপমহাদেশের সংগীত ও সংস্কৃতির আদিপীঠ স্থান বা তীর্থভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখানে হাজার বছরের লোক কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লোক-মানসের ঐতিহ্য। আছে ধ্রুপদী সংগীতের নিজস্ব ঘরানা। তিতাসের নৌকা বাইচ, সরাইলের হাঁসলী মোরগ, ভাদুঘরের বান্নি, সার্কাস ও যাত্রা, নবীনগরের লাঠিখেলা ও ষাঁড় দৌড় এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশেষ দিক। সংগীতের প্রবাদ পুরুষ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, সাধক আনন্দ স্বামী, সাধক মনোমোহন, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, শচীন দেব বর্মণ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খাঁ, অমর পাল, ওস্তাদ খুরশিদ খান, ওস্তাদ সুবল দাস, শেখ সাদী খান, সৈয়দ আবদুল হাদী, উমেশ চন্দ্র রায় প্রমুখ

সংগীতে বিশেষ অবদান রেখেছেন জেলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোক সংগীতের ব্যাপক অংশ এখনও অনাবিষ্কৃত অজ্ঞাত রয়ে গেছে। বহুসংখ্যক ভাবসংগীত পালাগান, বাউলগান, মুর্শিদীগান, মারফতিগান, বারোমাসি, পুঁথি, জারি-সারিগান সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। জেলা সমৃদ্ধ লোক সংগীত সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ অতি জরুরি।

জেলার সাহিত্য ইতিহাস খুঁজতে গেলে খুব বেশি দূর অতীতে যাওয়া যায় না। জেলার সাহিত্য চর্চার বিকাশ ঘটে আধুনিককালে এসে। সাধক কবি মীর্জা হোসেন আলী থেকে অদ্যাবধি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য বৈশিষ্ট্য বিশেষ গৌরবজনক। মানুষ ও মনুষ্যত্বের বিষয়ে আপসহীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য পরিবেশ মীর্জা হোসেন আলী থেকে কবি আল মাহমুদ এবং সাধক কবি মনোমোহন থেকে অদ্বৈতমল্লবর্মণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যের উজ্জ্বল অধ্যয়। মীর্জা হোসেন আলী, বানচন্দ্র তর্কালঙ্কর, মুন্সি ছমির উদ্দিন, দেওয়ান রামদুলাল নন্দী, কৈলাসচন্দ্র সিংহ, সাধক মনোমোহন ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন, কবি সুফী জুলফিকার হায়দার, কবি আব্দুল কাদির, কবি জমিলা বেগম, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গবেষক আ কা মো. যাকারিয়া, ইতিহাস গবেষক ড. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, কবি সানাউল হক, কবি ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান, কবি আহমদ রফিক, সাহিত্যিক মিন্নাত আলী, কবি মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি আল মাহমুদ, মোবারক হোসেন খান, সাংবাদিক ও গবেষক মুহম্মদ মুসা, কবি মনজুরে মওলা, কথা সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, তিতাস চৌধুরী, কবি শিহাব সরকার, শিশু সাহিত্যিক আলী ইমাম প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকগণ জেলা সাহিত্য চর্চা ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছেন এবং বর্তমানেও রাখছেন।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অগ্রসর অঞ্চলগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে জেলা জন্ম দিয়েছে অনেক শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঈসা খাঁ মসনদ এ আলা, নবাব সিরাজুল ইসলাম, রামকানাই দত্ত, মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, বিপ্লবী অখিল চন্দ্র দত্ত, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, মাওলানা মোহাম্মদ হুসাইন (রহ.), মাওলানা রুকন উদ্দিন, বিশ্ববিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম, বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কৃষক নেতা আব্দুল মালেক, মৌলবী জিল্লুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক হরলাল রায়।

জেলা ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যুগে যুগে অসংখ্য ধর্ম প্রচারকের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। তারা এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারে ব্যাপক অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-- হযরত সৈয়দ আহমদ গেদুদারাজ কল্লা শহীদ, হযরত কাজী মাহমুদ শাহ, হযরত শাহ সুফী আব্দুল খালেক, ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, হযরত মৌলানা আসগর আহমদ আল কাদরী, হযরত মাওলানা হাছান শাহ, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন, সৈয়দ আব্দুল রাবী শাহ প্রমুখ। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী, সাধক আনন্দ নন্দী, সাধক মনোমোহন প্রমুখ।

আর ফাইলের মসজিদ (সরাইল), উলচাপাড়া মসজিদ (সদর), কাল ভৈরব মূর্তি ও মন্দির (সদর), বাসুদেব মূর্তি (সরাইল), ঐতিহাসিক হাতিরপুল (সরাইল), কৈলাঘর দুর্গ (কসবা), ভাদুঘর মসজিদ (সদর) বাঁশীহাতে শিবমূর্তি (নবীনগর), আনন্দময়ী কালী মূর্তি (সরাইল), আর্কাইভ মিউজিয়াম (সদর) ইত্যাদি হলো জেলার দর্শনীয় স্থান।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে তিতাস নদীতে নৌকা বাইচ, নবীনগরের ষাঁড় দৌড়, গরুর লড়াই, সরাইলের মোরগ লড়াই, বারনী বা বান্নি মেলা।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক বা মফস্বল সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ ক্ষেত্রে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উনিশ শতকের শেষার্ধে ত্রিপুরা জেলা তথা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সংবাদপত্র ও সাময়িকীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্থানীয় সংবাদপত্র মাসিক ঊষা (১৮৯৩) এবং মাসিক হীরা (১৮৯৪) প্রকাশিত হয়। সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত ঊষা, হীরা, জয়ন্তী ও সেবক পত্রিকা বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গ্রাম থেকে পত্রিকা প্রকাশ বিশেষ করে চুন্টা প্রকাশ ও ‘পল্লী প্রদীপ' জেলার সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ইতিহাস এক উজ্জ্বল সূচনা করেছে। জেলায় সংবাদপত্র প্রকাশের ১১৮ বছরের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। জেলা সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-- মাসিক ঊষা (১৮৯৩), মাসিক হীরা (১৮৯৪), মাসিক সন্তান (১৯১৩), মাসিক পল্লী প্রদীপ (১৯২০), মাসিক চুন্টাপ্রকাশ (১৯২৬), মাসিক জয়ন্তী (১৩৪৬ বাংলা), মাসিক মা (১৯৬৯), মাসিক ভোলা (১৯৬৮), ত্রৈমাসিক আল বুশরা, প্রবাহ, সাহিত্য লোক, মান্দাল, ধূমকেতু, সাপ্তাহিক ত্রিপুরা বিকাশ, সেবক, তিতাস মা, প্রতিচ্ছবি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাকিয়াত তিতাসের খবর, দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া, প্রজাবন্ধু, আজকের হালচাল, তিতাস কণ্ঠ, রাহবার, সমতট বার্তা, দিনদর্পন ইত্যাদি।

রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রেমিট্যান্স প্রদানেও এ জেলার অবদান উল্লেখযোগ্য।

তবে কিছু কিছু ঘটনায় সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায়। শনিবারের (১৮ এপ্রিল) ঘটনাটিও (করোনার লকডাউনের মধ্যেও জানাজায় জনসমুদ্র) তেমনি একটি। এছাড়াও রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের শিরোনাম এই জেলা জেলা।

মফস্বলের মানুষের মধ্যে সচেতন থাকার প্রবণতা এমনিতে একদমই কম। এর অন্যতম কারণ, এ রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে কুসংস্কার চর্চা। আজকের ঘটনা অতিরিক্ত আবেগের ফসল। এই আবেগ যে তাদেরকে তথা দেশবাসীকে পৃথিবী থেকে সাবেক করে দিতে পারে এটা মাথায় ছিলনা কারোরই। ফলে যা হবার তা হয়েছে।

আর এমন ঘটনার প্লট যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজনকে ঘিরে, এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে সোনার বাংলার অন্যান্য জেলার দামাল-কামাল তৌহিদি জনতা। তারা দলে দলে ট্রাকে-ভ্যানে করে নেকী হাসিলের আশায় শামিল হয়েছেন। কিন্তু নেকীর আশায় জমায়েত হলেই যে করোনাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না এটা তাদের কে বোঝাবে?

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত