ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

ফুটপাতে এরা কারা?

ফুটপাতে এরা কারা?

রাজধানীর ফুটপাতজুড়ে বসে আছে সারি সারি মানুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা দরিদ্র শ্রেণির। প্রায় ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে আসা কোনও গাড়ি যদি কোন কারণে গতি কমায়, তখনই দলে দলে গাড়িটির দিকে ছুটে যায় মানুষগুলো। কিছু সাহায্য পাওয়ার আশায়।

লকডাউনের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে যেসব মানুষকে রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসতে হয়, তাদের চোখে এমন দৃশ্য পড়াটা স্বাভাবিক।

এমন ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে, সত্যি সত্যিই গাড়িতে করে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এসেছেন কেউ। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব না মানা এই মানুষগুলোর ধাক্কাধাক্কি সামাল দিতে না পেরে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রেখেই চলে যেতে হচ্ছে দাতাকে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যে এক মাসেরও বেশি সময় কার্যত অচল ছিল পুরো দেশ। এই সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পাশাপাশি এই দৃশ্যটিও আজকাল হরহামেশা চোখে পড়ছে।

এ ধরণের জমায়েত খুব বেশি দেখা যায়, সুপারশপ বা দোকানের সামনে, কিংবা রাস্তার মোড়গুলোতে।

সরেজমিনে জাহাঙ্গীর গেট

মিরপুর থেকে গুলশানে অফিস যেতে বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদককে জাহাঙ্গীর গেট নামে পরিচিত ঢাকা সেনানিবাসের মূল ফটক অতিক্রম করতে হয়। এর একটু দূরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস এবং স্থাপনা আছে এই এলাকায়।

সড়কটি ভিআইপি, অর্থাৎ এখানে কেবল যন্ত্রচালিত যানবাহনই শুধু চলতে পারবে। রিকশা-ভ্যানের মতো যানবাহন চলবার সুযোগ নেই।

প্রতিদিন অফিস যাওয়ার এবং বাসায় ফেরার পথে এখানকার ফুটপাতে এমন মানুষের জটলা দেখা যায়। যারা বসে আছেন তাদের সবাই নারী। তবে তাদের কাউকেই ভিখিরি বলে মনে হলো না। করোনাভাইরাসের কারণে মাস্কও পড়েছেন বেশিরভাগ।

তবে চোখে সাহায্যের আকুতি নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো না। কড়া রোদ উপেক্ষা করে রাস্তার ধারের দেয়াল ঘেঁষে বসে আছেন তারা।

'কাজ দেন নাইলে খাওন দেন'

এদের একজনের নাম ফাতেম, মধ্যবয়সী নারী। তার বাড়ি উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলায়। পেশায় একজন গৃহপরিচারিকা। লকডাউন শুরু হতে না হতেই ঢাকায় যারা সবার আগে জীবিকা হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন এসব খণ্ডকালীন গৃহপরিচারিকারা।

ফাতেমা জানায়, ‘লোকজন ৫-১০ টাকা দেয়, কেউ বা চাল দেয়, তাই আসছি।’

ফাতেমা কোনও সরকারি ত্রাণ পাননি। একজন ভোটার আইডি নিয়ে আসতে বললেও ত্রাণ দেয়নি।

একটু দূরে ওড়না দিয়ে মাথা আর মুখ ঢেকে বসে ছিলেন নাসিমা। নাসিমা তার ছদ্মনাম। নিজের নাম প্রকাশে ঘোরতর আপত্তি এই তরুণীর। তিনিও পেশায় গৃহপরিচারিকা।

কথা বলতে গিয়ে কান্নায় জড়িয়ে এলো তার কণ্ঠ। বরিশালের মেয়ে নাসিমার দুই সন্তান, মা আর ছোট ভাই থাকে গ্রামে। ঢাকা থেকেই খরচ পাঠাতে হয় তাদের জন্য। তার পাঠানো টাকায় গ্রামের সংসার আর সন্তানদের পড়াশোনা চলে। এখন ঢাকায় নাসিমার কোন কাজ নেই।

তিনি জানান, সাহায্য চাইতে গিয়েও মারধরের শিকার হতে হচ্ছে।

নাসিমা বলেন, ‘আমরা তো কাজ করে খাইতে চাই, ভিক্ষা করতে চাই না। কাজ দেন, নাইলে খাওন দেন। দূরে থাকেন, কিন্তু খাওন দিয়া যান।’

নাসিমাকেও ত্রাণ দেবেন বলে পরিচয়পত্র আর মোবাইল নাম্বার নিয়েছিলেন একজন। কিন্তু সারাদিন অপেক্ষা করেও নাসিমা পাননি সেই কাঙ্ক্ষিত ত্রাণ।

নাসিমা আরও জানান, বয়স কম বলে কেউ তাকে সাহায্য করতে চায়না। তার তার প্রশ্ন, ‘আমারে ত্রাণ দেয় না। বলে কাজ করে খেতে। আমরা তো কাজ করতেই চাই। কাজ দেন। আমরা ভিক্ষা করতে চাই না। আপনারা কাজ দেন না, ত্রাণ দেন না, আমাদের কি ক্ষুধা নাই?’

চাকরি করেও যে সংসার চলে না

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকাদের আর একজন হলেন পেয়ারা বেগম। তিনি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার কাজ করেন। অস্থায়ী এই চাকরির মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা।

বাড়িতে অসুস্থ স্বামী, এক মেয়ে আর দুই ছেলে রয়েছে তার। পেয়ারা বেগম আর বড় ছেলের মিলিত আয়ে সংসার চলতো তাদের।

ধোলাইপাড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ভালই কাটছিল দিন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর, ছেলের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র আয় এখন পেয়ারা বেগমের মাসিক বেতন। কিন্তু তাতে সংসার চলে না। উপায় না দেখে সাহায্যের আশায় রাস্তায় নেমেছেন তিনি। তবে সেটিও জুটছে না ঠিকমতো।

‘আমি গেলে বলে আপনি তো সরকারি চাকরি করেন, আপনি পাবেন না। কিন্তু আমি বুঝাইতে পারি না যে, আমার সংসার চলে না। কেউ দেয় না, যা হয় তাই খাই। আমাদের কথা শোনার কি আর মানুষ আছে? বলেন পেয়ারা বেগম।

কথা দিয়ে কী পেট ভরে?

নাসিমা বা পেয়ারা বেগম- কথা বলার সময় কেউই কান্না ধরে রাখতে পারেননি। কণ্ঠে কান্নার রেশ না তেমন একটা না থাকলেও চোখ গড়িয়ে ঠিকই নামছিল অশ্রু। জানান দিচ্ছিল, কতটা অনিচ্ছা নিয়ে ত্রাণের খোঁজে নেমেছেন তারা।

তবে, এরা ছাড়াও দেয়ালের ধার ঘেঁষে বসে থাকা আরো অনেকে ছিলেন যারা ওই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে চাননি। কারণ, তাদের প্রয়োজন সাহায্য, কথা দিয়ে তো আর পেট ভরবে না!

কেউ কেউ তো বলেই বসলেন, ‘ত্রাণ আনলে দেন। কথা দিয়া তো আর পেট ভরবো না।’

শুধু জাহাঙ্গীর গেট নয়, রাজধানীর এমন অনেক এলাকায় এখন এ ধরনের মানুষের সারি চোখে পড়ে। কেবল নারী নয়, পুরুষ থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই আছেন ত্রাণের আশায় বসে থাকা এই দলে। আর তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়েও ক্ষুধার কষ্ট বেশি যন্ত্রণাময়।

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত