পুরনো রূপে ফিরছে রাজধানী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২০, ১৯:১৩ আপডেট : ০২ জুন ২০২০, ১৯:২০
‘তিলোত্তমা ঢাকা’ ফিরছে আপন রূপে। সেই লম্বা গাড়ির সারি। দীর্ঘক্ষণের জ্যাম আর ক্ষণে ক্ষণে লম্বা হর্ণে দিনকে দিন নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে রাজধানী। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে গতকাল সোমবার চালু হয়েছে দেশের অফিসগুলো। সেইসাথে চালু হয়েছে গণপরিবহনও।
আজ সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় অনেকটা আগের মতোই ঢাকার রাস্তা-ঘাটে মানুষজন নেমেছে। কর্মব্যস্ত হয়ে উঠছে রাজধানী। পল্টন, মতিঝিলের মত অফিসপাড়ায় দেখা যায় স্বাভাবিক সময়ের মতন ভিড়। ফুটপাতে মানুষের সাথে মানুষের গা লাখিয়ে চলতে দেখা যায়। শাপলা চত্ত্বর থেকে সিটি সেন্টার পর্যন্ত এলাকায় কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেউ চলতে পারেনি। পল্টনের ফকিরাপুলের দিকেও ছিলো একইরকম ভিড়।
তবে, রাস্তায় অবশ্য নিজস্ব সুরক্ষার কথা চিন্তা করে মাস্ক ব্যবহারে করে চলাচল করেছেন পথচারীরা। অনেককে আবার গ্লাভস পরিহিত অবস্থায়ও দেখা যায়। কিন্তু মাস্ক ছাড়াও কিছু মানুষকে চলাচল করতে দেখা যায়।
এদিকে সোমবার সকাল থেকেই ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। ঘাটের ১০ নম্বর পন্টুনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। অথচ সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার ন্যূনতম লক্ষণ দেখা যায়নি। যাত্রীদের গাদাগাদি করে ঘাটে চলাচল করতে দেখা গেছে। অনেকের মুখেই মাস্ক ছিলো না, কেউ কেউ গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে চলাফেরা করেছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি করায় শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ একদিনেই প্রায় তিন হাজার করে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। মূলত সাধারণ ছুটি কার্যকর না হওয়া, পর্যায়ক্রমে ছুটির শর্ত শিথিল করা, গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরা ও ঢাকা থেকে ফেরত যাওয়া, ঈদ উপলক্ষে শপিং মল, বিপণিবিতান খুলে দেয়া, সাধারণ ছুটি পালনে সরকারি সংস্থাগুলোর নমনীয়তার কারণেই এখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। সাধারণ ছুটি তুলে দেয়ার পর করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে কী না এর ফলাফল পাওয়া যাবে আরো ১৪ থেকে ২১ দিন পর।
করোনা সংক্রমণের উদ্বেগজনক পরিস্থিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মানুষের অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি হলে জনস্বার্থে সরকার আবারো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনা প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়, যা গত ৩০ মে শেষ হয়। ৩১ মে সরকারি ও বেসরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়েছে। গতকাল থেকে দেশব্যাপী গণপরিবহনও চালু হয়েছে। যদিও এর আগে সাধারণ ছুটির মধ্যেই গত ২৬ এপ্রিল পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়। এর দুই সপ্তাহ পর থেকে দেশে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে, যা এখনও বাড়ছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা ফেরতরা ঢাকায় আসার পর অনেক মানুষের একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ মতিঝিলের মতো ডাউনটাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খুলে দিলেও রাস্তায় মানুষের জট হবে; সংক্রমণ ছড়াবে। আমরা রোগ সংক্রমণ কমানোর পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছি। করোনা সংক্রমণ চূড়া থেকে নামার দুই সপ্তাহ পরে বোঝা যাবে চূড়া থেকে নেমেছি কীনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রথমদিকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে করোনা সংক্রমণ বেশি ছিল। পরবর্তীতে তা সারাদেশে ছড়িয়েছে। প্রথমদিকে ওই তিন জেলাকে ‘লকডাউন’ (অবরুদ্ধ) করা হলে করোনার প্রায় ৮০ শতাংশ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সরকারি প্রশাসন লকডাউন ঘোষণা না করে বার বার সাধারণ ছুটি বাড়িয়েছে। তাছাড়া ওই সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কম ছিলো।
প্রসঙ্গত, দেশে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৭০৯ জন মারা গেছেন। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৫২ হাজার ৪৪৫ জন।
চীনের উহান থেকে বিস্তার শুরু করে গত চার মাসে বিশ্বের ২১২টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। চীনে করোনার প্রভাব কমলেও বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশে মহামারি রূপ নিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬৪ লাখ ছুঁই ছুঁই। মারা গেছেন তিন লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে ২৯ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি রোগী ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।
করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। উপসর্গগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।
বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে