ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বানভাসীদের ঈদ

  জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২০, ২১:২৮

বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বানভাসীদের ঈদ

‘পেঠেই ভাত দিবার পাইতাছিনা আংগরে আবার ঈদ! পোলাপান কান্দাকাঠি করতাছে, ঈদ আইয়া পড়লো নয়া কাফর কিনা দেও। পেঠে ভাতই দিবার পাইতাছিনা নয়া কাফর কিন্যা দিমু ক্যামনে। আল্লায় আমগো কফালে ঈদের আনন্দ লেহেনাই।’ এভাবেই চোখের পানি ফেলে কষ্টের কথাগুলো জানালেন জামালপুর শহরের নাওভাঙ্গা চরের বানভাসী ৬৫ বয়সের বৃদ্ধা হালিমা বেগম। তার স্বামী ওয়াসিম উদ্দিন রিকসা চালাতেন। একমাস যাবৎ বাড়িতে পানি উঠায় শহর বাইপাস রোডের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধে থাকছে পরিবার পরিজন নিয়ে।

৫০ বছর বয়সী বানভাসী রিকসাচালক ফরহাদ মিয়া পরিবারের ১০ সদস্য নিয়ে দেড় মাস ধরে বাঁধে বসবাস করছেন। তাদের ঈদ এবার বাঁধেই কাটবে। নতুন কাপড়ের বায়নায় পরিবারের শিশুদের কান্না থামাতে না পেরে চোখ বেয়ে পড়ছে জল। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আল্লায় ক্যান আংগরে গরিব বানাইছে। পোলাপানের কান্দন ক্যামনে থামামু।’

চোখের সামনে বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে বন্যার পানির ধাক্কায় ঘর বাড়ি ও সহায় সম্ভল ভেসে যাওয়ার করুণ কাহিনী তুলে ধরে বানভাসী হিমানী বেগম বলেন, ‘আমগো আবার ঈদ আছে। একবেলা খাইলে পরের বেলা কি খামু হেই চিন্তাই মাতা খারাপ। পোলাপান নতুন কাফরের জন্যে কান্দাকাঠি করতাছে।’

কথা হয় দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে আছিয়া বেগম (৪৫) এর সাথে। যমুনা নদীর তীরবর্তী চর হালকা হাওড়াবাড়ি গ্রামে তার বাড়ি। তাদের ঘরবাড়ি পানির নিচে। দেড়মাস ধরে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। পরিবার পরিজন ও গৃহপালিত গরুছাগল নিয়ে এখানেই বসবাস করছেন গাদাগাদি করে। তিনি জানান, ত্রাণ পেলে পেটে খাবার জুটে। এক বেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। ছেলে মেয়েদের চোখেমুখে তাকাতে পারছেনা। ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না ধরে কান্নাকাটি করছে। অবুঝ সন্তানরা আমার অসহায়ত্বে কথা বুঝাতে চাইছেনা বলে আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলেন।

একই গ্রামের আবুল হাসেম। বয়স ৫৫। চার ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। কংকালসার শরীর। বন্যাকালীন ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শরীর ভেঙে পড়েছে আবুল হাসেমের। আমাদের দেখে ত্রানকর্মী ভেবে ছুটে আসে সে। বলে বাবা বুড়া মানুষ ঠেলাঠেলি করে ত্রান নিতে পারিনা। আমার নামটা লেখেন। আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিতেই চুপ হয়ে যায়।

ঈদ নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলেন, ‘ছেলে মেয়ে নাইনাতির চিৎকারে থাকতে পারছিনা। যেহানে খাইতে পারিনা কাফর কিনে দিমু ক্যামনে। আল্লায় ক্যান যে আমগো গরিব বানাইছে। তারমধ্যে বানে এবার ঈদের আনন্দ মাটি কইরা দিছে।’

হালিমা বেগম, ফরহাদ মিয়া, হিমানি বেগম,আছিয়া বেগম ও আবুল হাসেম মতো মতো বন্যা দুর্গত এলাকায় সন্তানদের ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না মেটাতে না পেরে সকলেই একই কথা বললেন।

বন্যায় আক্রান্ত ইসলামপুরের চিনাডুলি, বেলগাছা, পার্থশী, নোয়ারপাড়া, সাপধরী, দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানি, চুকাইবাড়ি ইউনিয়ন ও জামালপুর শহরের নাওভাঙ্গাসহ বন্যদূর্গত গ্রামগুলোতে ঈদ আনন্দ নিরান্দনে পরিণত হয়েছে। ঈদে নতুন কাপড়ের বায়নায় শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরে ঘরে থেকে। ঈদ আনন্দের বদলে জীবন বাঁচাতে ত্রানের সন্ধানে ছুটাছুটি আর মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিতে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে বন্যা দুর্গতরা।

বন্যা ও নদী ভাঙনে ফসল সম্পদহানীর সঙ্গে সঙ্গে জামালপুরের যমুনাপাড়ের মানুষের মুখ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আসন্ন ঈদুল আযহার আনন্দ। এ কারণে ঈদের আনন্দ নেই বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে। তাই ঘরে ঘরে ঈদ প্রস্তুতির লেশমাত্র নেই বললেই চলে।

ইসলামপুরের চিনাডুলির বড় গৃহস্থ্য হিসেবে পরিচিত আব্দুল মজিদ (৬৬)। এই সময়টা তিনি কুরবানীর জন্য গরু কেনা, ঘরের বাজার সদাই আর পরিবার পরিজনের নতুন কাপড় কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পশু কুরবানি,দুস্থদের মধ্যে মাংস বিলানো, বাড়িতে মেহমানদারিতে আনন্দে কেটে যায় ঈদের দিন। ২০ বছর ধরে এভাবেই ঈদুল আজহা কেটেছে কৃষক আব্দুল মজিদের। কিন্তু এবার ছিঁটেফোটাও স্পর্শ করবেনা তাকে। কারণ ফসল হারিয়ে তিনি নিঃস্ব, নিজেই এখন ‘দুস্থ’। সন্মানের ভয়ে চক্ষু লজ্জায় ত্রানও নিতে পারছেন না, হাত পাততেও পারছেন না মানুষের কাছে। সংসারে দু’বেলা ভাত যোগাতে হিমশীম খাচ্ছেন। যমুনাপড়ের সর্বত্র দূর্গত মানুষের ধনী গরিব সকলের ঈদ আনন্দ নিয়ে একই জীবনচিত্র বিরাজ করছে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত