ভরা বর্ষায় জমজমাট নৌকার হাট
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২০, ১৬:১৪
গোটা দেশেই এখন বন্যা চলছে। রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলসহ আশেপাশের অনেক এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে মানুষের যাতায়াতের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে নৌকাই এখন একমাত্র ভরসা। ছোট বড় সব ধরনের নৌকার চাহিদা এখন তুঙ্গে। যেমনই হোক একটা নৌকা সবারই দরকার। নৌকার খোঁজে মানুষ ছুটছে পাশের হাটগুলোতে।
ভরা বর্ষায় জমজমাট রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ও গোলাকান্দাইল নৌকার হাট। চাহিদা বেশি, দামও একটু বেশি। হাটের দিন মানুষের ঢল নামে। এছাড়াও কারিগরদের বাড়িতেও নৌকা বেচাকেনা হচ্ছে। নৌকা তৈরির কারিগরদের এখন দম ফালানোর ফুসরত নেই। হাটে ঘাটে এখন মানুষের ভিড় আর নৌকা বেচাকেনার ধুম চলছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার বালু নদীর তীরে কায়েতপাড়ায় জমে উঠেছে নৌকার হাট। বর্ষা ও পানির এ মৌসুমে রাজধানী ঢাকার পূর্বাঞ্চলের নদী-নালা খালবিল সর্বত্রই পানিতে টইটুম্বর থাকে। এ মৌসুমে সহজে পথ চলাচলসহ ফসল ফলাদি বহনের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় নৌকা।
বছরের অন্য সময় নৌকার চাহিদা কম থাকলেও এ সময়টায় নৌকার চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। বর্ষা ও পানির মৌসুমকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে রূপগঞ্জের বালু নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী কায়েতপাড়ার নৌকার হাট। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভিড়ে এখন সরগরম এ হাট। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বালুনদী তটে বসে এ হাট।
নদীমার্তৃক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একসময় যোগাযোগের অন্যতম বাহন ছিল ডিঙি নৌকা বা কোসা। বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী বেষ্টিত রূপগঞ্জ উপজেলার প্রায় সীমানাজুড়েই খাল-বিল ও নদী-নালায় ভরপুর। ফলে বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলে নৌকার কদর অনেক বেশি। নিন্মাঞ্চলগুলো ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার কায়েতপাড়া ও গোলাকান্দাইল এলাকায় নৌকার হাটে চলছে বেচাকেনার ধুম।
সরজমিনে ঐতিহ্যবাহী কায়েতপাড়া ও গোলাকান্দাইল নৌকার হাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার মাঠজুড়ে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়েছে শত শত কোসা ও ডিঙি নৌকা। ক্রেতা বিক্রেতাদের দর কষাকষি চলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররাও নৌকায়, ট্রলারে, ট্রাকে ও ভ্যানে করে হাট থেকে নৌকা ক্রয় করে নিয়ে যান। আর যেসব এলাকায় বর্ষার পানি প্রবেশ করেছে হাটে, সেসব এলাকার মানুষজনের ভিড় বেশি। তবে নৌকার দাম অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।
কথা হয় নৌকা কিনতে আসা বেশ কয়েকজন ক্রেতা বিক্রেতা ও নৌকা তৈরির কারিগরদের সাথে। নগরপাড়া কাজীবাড়ি এলাকার আবুল হোসেন জানান, ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে তিনি একটি ডিঙি নৌকা বিক্রি করেছেন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকায়। তখন ডিঙির চাহিদাও ছিল প্রচুর। কাঠসহ ডিঙি তৈরির অন্যান্য উপকরণের দাম ছিল অনেক কম। তখন কেউ কেউ শখ করে শালকাঠ দিয়ে বড় আকারের ডিঙি নৌকা তৈরি করতো। শাল কাঠের একটা নৌকা ১৫ থেকে ২০ বছর ব্যবহার করা হতো।
শীতল সূত্রধর জানান, কায়েতপাড়া হাট ছাড়াও উপজেলার গোলাকান্দাইলে বসে এ ধরনের নৌকার হাট।
উপজেলার নয়ামাটি এলাকার নৌকা তৈরির কারিগর আব্দুল হক জানান, জৈষ্ঠ্য মাস থেকেই তারা নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন। ভাদ্র মাস পর্যন্ত তারা ব্যস্ত থাকেন নৌকা তৈরির কাজে। সপ্তাহে তার অধীনে গড়ে অন্তত ১০টি নৌকা তৈরি হয়। নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় মূলত কড়ই, জাম্বুল, কদম, আম কাঠ। দশ হাত লম্বা আর তিন হাত পাশের একটি ডিঙি নৌকা বিক্রি হয় সাত থেকে দশ হাজার টাকা। তবে উন্নত মানের কাঠ হলে একই মাপের একটি ডিঙির দাম হতে পারে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
কায়েতপাড়ার হাটে ডিঙি নৌকা কিনতে এসেছেন উপজেলার ইছাপুরা এলাকার মেহের উদ্দিন। তিনি জানান, প্রতিবছর বর্ষায় তার একটি করে ডিঙি নৌকা কিনতে হয়। গত বছরের ডিঙিটি এ বছরও কয়েক দিন চালিয়েছে। কিন্তু কাঠ পচে যাওয়ায় নতুন আরেকটি কিনতে এসেছেন।
তিনি আরো জানান, রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড়ের মানুষ আজো অবহেলিত। নয়ামাটি, বাঘবাড়ি, দেইলপাড়া, চানখালি, দাসেরকান্দি, ইদেরকান্দি, বালুরপাড়, ফকিরখালি, বরুনা, বসুলিয়া ও নিমের টেকের মানুষ আজও আধুনিক যোগাযোগ বঞ্চিত। বর্ষায় নৌকাই তাদের একমাত্র ভরসা।
প্রবীণ ব্যবসায়ী নারায়ণ চন্দ সরকার বলেন, 'বাপ-দাদাগো কাছে হুনছি (শুনেছি) বিট্রিশ আমল থেকেই এখানে হাট বসতো। বর্ষা মৌসুম এলেই এ উপজেলার নয়ামাটি, পিরুলিয়া, গোলাকান্দাইলসহ আশেপাশের এলাকার কাঠ মিস্ত্রিরা নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব এলাকার দুই শতাধিক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে নৌকা-বৈঠা তৈরি ও বিক্রি করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
বাঘভেড় এলাকার নৌকা তৈরির কারিগর নীলাম্বর জানান, একটি নৌকা তৈরি করতে দু’জন মিস্ত্রীর সময় লাগে একদিন। নৌকার সাইজ ও কাঠের ধরনভেদে পাঁচ হাজার টাকা থেকে পঁচিশ হাজার টাকায় বিক্রি হয় একেকটি নৌকা।
ব্যবসায়ীরা জানান, এক শ্রেণির দূরাগত পাইকাররা এখান থেকে নৌকা কিনে বিভিন্ন এলাকার হাটে নিয়ে বিক্রি করেন।
ফকিরখালি এলাকার বিপ্লব মিয়া জানালেন, নিজেদের চলাচল ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে খাল-বিল, চকে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হয় ডিঙি নৌকা। একটু বড় আকারের ডিঙি নিয়ে তারা নদীতেও মাছ ধরতে যান।
গোলাকান্দাইল নৌকার হাটে কথা হয় নিতাই মাঝির সাথে। তিনি জানান, সারা বছর নদীতে নৌকা চালাই আর মাছ ধরি। নৌকাই তাদের অবলম্বন। তাই প্রতি বছরই হাট থেকে নৌকা কিনতে হয়।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, কায়েতপাড়ার নৌকার হাটটি অনেক পুরানো। তবে গোলাকান্দাইল হাটটিও অনেক আগের। এখন আর আগের মতো নৌকার হাটের জৌলুশ নেই। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে মানুষ এখন নৌপথে যাতায়াত কম করেন। তাই নৌকার চাহিদাও কম।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে