ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

হারাতে বসেছে বাঙালির ঐতিহ্যের নৌকা বাইচ

  ফরিদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:১৪

হারাতে বসেছে বাঙালির ঐতিহ্যের নৌকা বাইচ

একসময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদীকেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা। গ্রাম বাংলায় নৌ-শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র। নৌকাবাইচ সমন্ধে গ্রাম বাংলার অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে জনশ্রুতি আছে। ইট-পাথরে গড়া আধুনিক সভ্যতার ভিড়ে গ্রাম-বাংলা থেকে ‘নৌকা বাইচের’ মতো ঐতিহ্যকে মানুষ ভুলতে বসেছে।

আবহমান গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি ও নিজস্বতা ধরে রাখতে ফরিদপুরে প্রায় প্রতি বছরই আগে আয়োজন করা হতো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার। শহর জীবনের কোলাহল ছেড়ে কিছুটা সময়ের জন্য দর্শনার্থীরা নৌকা বাইচ উপভোগ করেন এবং গ্রামীণ এই সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে থাকেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সুষ্ঠভাবে বেড়ে উঠার জন্যই এই ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ফরিদপুরে ব্যবহৃত হতো জনপ্রিয় গয়না নৌকা। গয়না দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০০ ফুট থেকে ১২৫ ফুট মাঝখানে ৮ থেকে ৯ ফুট প্রশস্ত। এর সামনের দিকটা পানি থেকে ৩ ফুট ও পেছনের দিকটা পানি থেকে ৪, ৫ ফুট উঁচু হয়।

বাইচের নৌকার রঙিন নাম:

বাইচের নৌকাগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, অগ্রদূত, ঝরের পাখি, পঙ্খিরাজ, মযূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফান মেল, সোনার তরী, দ্বীপরাজ ইত্যাদি। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকা দেখা যায়। বাইচের নৌকার গঠন কিছুটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখীর মুখাবয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে।

নৌকা বাইচের নিয়ম কানুন, গানবাজনা ও উৎসব:

নৌকায় ওঠার আবার অনেক আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। দাঁড়িয়ে থেকে নৌকা চালান পেছনের মাঝিরা। প্রতিটি নৌকায় ৭, ২৫, ৫০ বা ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন।

উপযুক্ত নৌকায় দু’পাঁশে মাঝিরা সারি বেঁধে বসে পড়বে বৈঠা হাতে। মাঝিদের বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন পরিচালক থাকে যাকে বলা হয় 'গায়েন'। সে বসবে নৌকার গলুই-এ। মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই এক সাথে কোনো একটি গান গাইতে আরম্ভ করে এবং সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে; যার ফলে কারো বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে এক সাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুরে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদীর কোল ঘেঁষে প্রতি বছর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। কাসা, ঢোল ও বৈঠার সলাৎ সলাৎ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে গ্রাম। গ্রামের লোকজন উৎসাহ দিতে নানা ধরণের নৌকা সাজিয়ে মাইক বেঁধে অবস্থান নেন নদীর কোলের দু’পাড়ে। দর্শনার্থীদের অংশগ্রহণে চরম উপভোগ্য হয়ে ওঠে নৌকা বাইচ। এ নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে নদী দু’পাড়ে বসে মেলা। কসমেটিক্স, মিষ্টি, খেলনাসহ বিভিন্ন দোকান বসে মেলায়। নৌকা বাইচ দেখতে আসা দর্শনার্থীরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নেন মেলা থেকে।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে জনসমাগমে বিধি নিষেধ থাকায় ফরিদপুরে এই উৎসবের আয়োজন করা যাচ্ছে না। এছাড়া নদী ও খাল না থাকার কারণে এখন আর আগের মত নৌকা বাইচ হয় না। অন্যদিকে ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে স্থানীয়দের উদাসীনতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, দেশীয় সংস্কৃতির লালনের অভাবে গ্রাম বাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী খেলা নৌকা বাইচ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

নৌকা বাইচকে ধরে রাখতে ও সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিতে ঐতিহ্যবাহী এ বাইচের আয়োজন করা দরকার। তারপরেও কোথাও অনুষ্ঠিত হবে এমন খবর পেলে সেখানে লোকজন ছুটে যায়। নদী ও খাল খনন করে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ নৌকা বাইচ আগামীতেও অনুষ্ঠিত হবে এমটাই আশা করছে সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত