একজন আদর্শ শিক্ষকের গল্প
আকিমুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা থেকে
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২০, ০৪:১০ আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২০, ০৪:১৩
মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে কাজ করছেন ৩১ বছর ধরে। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের তিনি সন্তানের মতই মমতা ও ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সর্বদা ভাল-মন্দ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখতে ভোলেন না শত ব্যস্ততার মাঝে। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি গরিবের শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। চলাফেরা ও জীবন যাপন করেন সাদামাটা ভাবে। নিজের আদর্শ ধরে রাখতে চান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাহকারী প্রধান শিক্ষক অহিদুল হকের শিক্ষকতা জীবনের গল্প।
সহকারী প্রধান শিক্ষক অহিদুল ইসলাম জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৪ সালে। তিনি মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বাবা ছিলেন একজন বর্গা চাষি। অভাবের সংসারে পাশ করার পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় ২ বছর। তারপর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৮৪ সালে এইচএসসি (বর্তমান) পাশ করেন।
এরপর বাবা অসুস্থ্য হলে বেশ কয়েক বছর বন্ধ হয় পড়াশুনা। ডিগ্রি ভর্তি হতে হবে জেলার বাইরে। পড়াশুনা বাইরে থেকে করতে হলে টাকার প্রয়োজন। কারণ বাবা অসুস্থ থাকায় তা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাবা সুস্থ হওয়ার পর ভর্তি হন খুলনা ডিগ্রি কলেজে।
শিক্ষক অহিদুল হক বলেন, মনোহর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরুল হক মারা যান ১৯৮৯ সালে। সেসময় বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান নজরুল ইসলাম একদিন আমার বাবাকে বলেন আপনার ছেলেকে দেখা করতে বলবেন। প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে তোমাকে বিনা বেতনে শিক্ষক হিসাবে ও হোস্টেলে দায়িত্ব পালন করতে হবে কয়েক বছর।
তিনি বলেন, মনোহরপুরসহ পার্শবর্তী গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র। তারা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলে পাঠাতেন না। স্কুলের ক্লাস শেষে নিয়মিত গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য বিদ্যালয়ে আসার জন্য বলতাম। আস্তে আস্তে ছেলে-মেয়েরা স্কুল মুখি হতে শুরু করলো। গ্রামে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পড়া তিনি ক্লাসে শেষ করাতেন। যারা দুর্বল শিক্ষার্র্থী ছিলেন তাদেরকে বাড়িতে আলাদাভাবে পড়াতেন। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেলেরা এসে স্কুল হোস্টেলে থাকতো। তাদের দেখাশুনা করতে হতো। শিক্ষার্থীদের তিনি ইংরাজি বিষয়ে পড়াতেন। ৮ম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন। সেখান থেকেই তার শিক্ষকতায় আসার আগ্রাহ তৈরি হয়। তিনি শিক্ষকতাকে আদর্শ ও মহৎ পেশা হিসাবে বুকে ধারণ করেন।
শিক্ষক অহিদুল হক আরও বলেন, অল্প বয়সে স্কুলের মেয়েদের অভিভাবকরা বিয়ে দিতো। আমি বিষয়টি জানা মাত্র বাল্যবিয়ে বন্ধ করতাম। বাল্যবিয়ের ভয়াবহতা কি তা বুঝাতে পারতাম। কয়েক মাস আসে স্কুলের ৯ম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন হচ্ছে শুনে তাদের বাড়িতে যাই। পরিবারের সদস্যদের বুঝাতে সক্ষম হই বিয়ে না দেওয়ার জন্য। বই, খাতা, কলম ও পোশাকের অভাবে অনেকের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছে শুনে আমি তাদের বাড়িতে গিয়ে বলেছি, তোমরা স্কুলে আসো আমি সব ব্যবস্থা করবো।
এসএসসি পাশ করার পর অনেকে কলেজ ও কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না টাকার অভাবে। তাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন অহিদুল হক। সর্বদা শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেন। বর্তমানে তার অনেক ছাত্র ভালো অবস্থায় রয়েছে। কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যশোর এমএম কলেজসহ বিভিন্ন দপ্তরে বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে সুনামের সাথে চাকরি করছেন।
সহকারী প্রধান শিক্ষক হওয়ার সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক ও নেতার কারণে। এ কথাও জানালেন তিনি।
বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও সকালে তিনি নিয়ম মেনে হাজির হন। ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রিয় প্রতিষ্ঠান। এরপর মাঠে ছুটে যান ধান ঝাড়ার জন্য। তিনি কোন কাজকেই ছোট মনে করেন না। বাইসাইকেল নিয়ে চলাফেরা করেন। সাধারণ জীবন-যাপন করেন।
তিনি বলেন, কোচিং একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা কেন জানি না বুঝে সারাদিন কোচিং কোচিং করে মাথা নষ্ট করে। ক্লাসের পড়া ক্লাসে শেষ করলে কোচিং এর প্রয়োজন হয় না। কোচিং এর কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার ও আচরণে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আগের দিনের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষকদের সাথে ভালো ব্যবহার করতো। রেজাল্ট বেশি ভালো হয় না। লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি বর্তমান সময়ে। কোচিং এ একটা সুবিধা আছে চাপে রাখে পড়াশুনার জন্য।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চান তিনি।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে