ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

বছরের শেষপ্রান্তে এসে হাসিটা কৃষকেরই

  পাবনা প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২০, ১৩:১০  
আপডেট :
 ২৩ অক্টোবর ২০২০, ১৩:২৫

বছরের শেষপ্রান্তে এসে হাসিটা কৃষকেরই

ধান, পাট, সবজির যে দাম পাচ্ছি তাতে আমরা খুশি। এরকম দাম সারা বছর থাকা দরকার। রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার উত্তরচক গ্রামের আব্দুল খালেক একথা বলেছিলেন। একই গ্রামের বীজ উৎপাদনকারী চাষী বিপ্লব সেনসহ অনেক চাষী এমনটি বলেছেন। বাজারে পণ্যের ভালো দাম পেয়ে কৃষকের মুখে এখন হাঁসি। তবে সাধারণ চাষিদের লাভবান করতে হলে মৌসুমেও ভালো দাম নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা তা অনেকাংশে মধ্যস্তভোগীদের পকেটে চলে যায় বলে চাষি সংগঠকরা বলেছেন।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত অর্থ বছরে (২০১৯-২০) ধান, গম ছাড়াও, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল, মসলা জাতীয় ফসল লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদিত হয়েছে। এবার ২০২০-২১ অর্থবছরে গত বছরের চেয়েও বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এবার ভালো ফলন হবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা আশাবাদী।

এদিকে পাবনার বিভিন্ন হাটবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি পণ্যের ভালো দাম। ধান বেচা-কেনা হচ্ছে এক হাজার টাকা থেকে সাড়ে ১১শ’ টাকা প্রতি মণ। পাট বেচা-কেনা হচ্ছে তিন হাজার থেকে ৩২শ’ টাকা প্রতি মণ। আর পেঁয়াজ বেচা-কেনা হচ্ছে তিন হাজার টাকা মণ (বড় পিঁয়াজ) আর বীজ বা ছোট পেয়াজ বেচা-কেনা হচ্ছে প্রতি মণ ৩৫শ’-৩৬শ’ টাকা। তরিতরকারিসহ তেল ও ডাল জাতীয় ফসলও ভালো দামে বেচা-কেনা হচ্ছে।

চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকের উচ্চ দাম আর কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে অনেক। কিন্তু বছরের পর বছর কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি। কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে না, আর উঠলেও সামান্য লাভ থাকে। যা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।

পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার চাষি আব্দুল বাতেন বলেন, যে টাকা খরচ করি আর যদি সেই টাকাই পাই তাহলে লাভ কী? জমি চাষ করে পরিশ্রম দিয়ে লাভটা কী হবে? তিনি জানান, বিগত বছরগুলোতে এমনটিই হয়ে আসছিলো। আমরা ধানের দাম পাইনি, পাটের দাম পাইনি, পেঁয়াজের দাম পাইনি, সবজির দাম পাইনি। ক্ষতি হতে হতে অনেক চাষি জমি আবাদ ছেড়ে জমি লীজ দিয়েও রেখেছেন বলে জানান তিনি। কিন্তু এ বছর চাষি সব ফসলেই লাভবান হচ্ছে। ওই চাষি বলেন, এমন দাম সারা বছর থাকলে আমরা খুশি হবো।

চাষিদের সাথে একমত পোষণ করে পাবনার দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক বলেন, বোরোতে লোকসান, আউশে খরা, আমনে হতাশা, এই হলো চাষির দশা। এমনটি বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে। তিনি বলেন, অথচ ধানই হলো চাষির জীবন রক্ষাকারী ফসল। এখনো দেশে মোট দানাদার খাদ্যশস্যের শতকরা ৯৫ ভাগ আসে ধান থেকে। দেশে মোট কৃষি জমির শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে ধান চাষ হয়। আবার মোট কৃষি আয়ের অর্ধেকই আসে ধান থেকে। প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষি শ্রমিক ধান চাষের সাথে সম্পৃক্ত। ধানের সাথে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক বিষয়টিও সম্পৃক্ত।

জাফর সাদেক বলেন, এদেশে ধান চাষের সাথে মহাজনী দাদনচক্রের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ধান চাষের সময়ে কৃষকের হাতে নগদ অর্থের অভাব থাকে বলে তারা গ্রাম্য মহাজনদের কাছে হাত বাড়ায়। মহাজনরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকে। কৃষককে ঋণ দেয়ার সময় শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, আসল টাকার সাথে এত মন ধান দিতে হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ষ্ট্যাম্পে চাষির স্বাক্ষর নেয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে কৃষকের উপর নেমে আসে অত্যাচার। বহু এলাকায় শ্রম দেয় কৃষক আর ফসল যায় মহাজনের গোলায়।

আবহাওয়া বিপর্যয়ের কারণেও ফসল চাষে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষককে এখন রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মৌসুমে কৃষক চাতকের ন্যায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কিন্তু বৃষ্টির দেখা মেলে না। যথা সময়ে ধান, পাট, সবজি কিছুই বোনা হয় না। খরার ধাক্কার পর শুরু হয় অসময়ের বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়ে যায় পাকা বা অধাপাকা ফসলের। কখনো কখনো অতি বৃষ্টির জন্য ফসল বোনাই সম্ভব হয়ে উঠে না কিংবা ক্ষেতে বীজ পচে নষ্ট হয়।

জাফর সাদেক আরো বলেন এ অবস্থার ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘায়িত হয় এবং ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায়। কৃষক আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। শুধু ধান ফসল নয় পাট, আখ, কাউন, চিনাবাদাম, গম, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন আবাদ করা হলেও বছরের পর বছর চাষি মার খাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। উপকুল থেকে শুরু করে উত্তরাঞ্চল, চরাঞ্চল, হাওরাঞ্চল সব জায়গায় কৃষি সংকট, কৃষকের জীবনের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার বাজার ভালো পাওয়ায় কৃষি ক্ষেত্রে যেন আমূল পরিবর্তন এসেছে।

তিনি বলেন, কৃষি পণ্যের ভালো দাম হওয়াটা ইতিবাচকভাবে দেখা দরকার। অন্য দশটি পেশার লোকজনের আয় বেড়েছে, ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু চাষির ফসলের ভালো দাম পেলেই দাম কমানোর দাবি ওঠে। কিন্তু চাষি ভালো দাম না পেলে তারা টিকে থাকবে কীভাবে?

পাবনার ঈশ্বরদীর খ্যাতিমান চাষি ও বাংলাদেশ ফামার্স এসোসিয়েশনের( বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি আলহাজ শাহজাহান আলী বাদশা জানান, চাষি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। সেই চাষিরা বছরের পর বছর ফসলের নায্যদাম পান না। তিনি দু:খ করে বলেন, এমন একটা মানসিকতা এসেছে সব কিছুর দাম বাড়বে, সবার আয় রোজগার বাড়বে কিন্তু চাষির পণ্যের দাম বাড়তে পারবে না। চাষি সারাজীবন যেন ধান দাম চারশো’ টাকা মণ দরে বেচে যাবেন।

তিনি আরো বলেন, এটা থেকে বেরিয়ে আসার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। দিন বদলেছে, তাই কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে এটা সবারই মেনে নিতে হবে। তাহলে এদেশের চাষি বাঁচবে, কৃষি বাঁচবে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পাবনা জেলা মার্কেটিং অফিসার হুমায়ুন কবীর জানালেন, এ বছর বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে অনেক ফসল ও সবজি নষ্ট হয়েছে। এজন্য বাজারে কিছুটা দাম বেড়েছে। তবে চাষি ভাল দাম পেলেই সেটাকে নেতিবাচক ভাবে না দিয়ে ইতিবাচক দিকটিও ভাবতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে চাষিরাও তো লাভবান হতে হবে। তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের আয় বেড়েছে। তাই সবার ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শামছুল আলম জানান, এবার কৃষকরা কৃষি পণ্যের ভালো দাম পাচ্ছেন। বাজারদর অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে এমনটিও নয়। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সবার আয় বেড়েছে। তাই চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন, এটা কৃষি কাজের জন্য আশার কথা। বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলে চাষিরা তো কৃষি পেশাটাকেই ছেড়ে দিবেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত