ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত, একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির

  আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২০, ১৩:৫১  
আপডেট :
 ২৫ অক্টোবর ২০২০, ১৬:২০

সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত, একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির

লালমনিরহাট জেলা শহরের কালীবাড়ি এলাকায় একই আঙিনায় গড়ে উঠেছে পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ি সার্বজনীন মন্দির। গোটা বিশ্বে যখন ধর্মে ধর্মে রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে তখন প্রতিদিন এ মসজিদে যেমন মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন তেমনি মন্দিরে চলছে ভক্তদের পূজার্চনা। দুর্গাপূজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশ ঝাকজমকভাবে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন। মসজিদ কমিটি’র লোকজন মন্দির কমিটি’র লোকজনকে বেশ সহযোগিতাও করছেন।

ধর্মীয় সম্প্রীতি কী? ধর্মীয় সম্প্রীতি কাকে বলে? আর তা কেমন হওয়া উচিৎ এটা জানার জন্য ও দেখার জন্য সবার যেন এখানে আসা উচিৎ।

একই আঙিনার পুরান বাজার জামে মসজিদটি জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ। এখানে নামাজ আদায় করতে দূর-দূরান্ত থেকেও মুসল্লিরা আসেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে এই মসজিদে সবসময় মুসল্লিদের ভিড় থাকে।

মন্দিরটিতে রয়েছে শ্রী শ্রী কালী মূর্তি, দেবাদিদেব মহাদেব, শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় স্বাভাবিক নিয়মে চলছে পূজার্চনা। এখানে রয়েছে শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির। প্রতি বছরের মতো এ বছরও জাঁকজমক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা।

ঝগড়া, বাকবিতণ্ডা, অভিযোগ বা অনুযোগ ছাড়াই যুগের পর যুগ একই আঙিনায় মন্দির ও মসজিদে বিরাজ করছে ধর্মীয় সম্প্রীতি। এ যেন সম্প্রীতির মহা মিলন। পৃথিবীজুড়ে চলমান সহিংসতা আর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংবাদের মধ্যে এমন দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একই আঙ্গিনায় মন্দির ও মসজিদ স্থাপন করেছে ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই আঙিনায় গড়ে উঠে একটি জামে মসজিদ। নাম দেয়া হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ। পরে মুসল্লিদের সহযোগিতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে মসজিদের অবকাঠামোতে। এক সময় এলাকাটি হয়ে উঠে নয়নাভিরাম।

দর্শনার্থী মুক্তি রানী বলেন, ‌সম্প্রীতির ‌‌‘অনেক আগেই একই আঙিনার মন্দির ও মসজিদ আছে শুনেছিলাম। কিন্তু, দেখতে আসার সময় হয়নি। এখন সময় পেলাম তাই দেখতে এলাম। খুবই ভালো লাগছে, আমি মুগ্ধ। এমন দৃশ্য যদি সারাবিশ্বে থাকতো তাহলে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হতো না। বিরাজ করতো শুধু শান্তি আর শান্তি।’

কথা হয় মসজিদের মুয়াজ্জিন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘মসজিদে আজান ও নামাজের সময় কোনো দিন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। এ সময়টাতে মন্দিরে পূজার্চনা হলেও কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকেন তারা। মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে আমার সবসময় কথা হয়, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে আলোচনা হয়।’

স্থানীয়রা বলছেন, কালীবাড়ি মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছর পুরনো। তৎকালীন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজার্চনা করতেন। তারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মন্দিরটি থেকে যায় অক্ষত। পরবর্তীতে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা আবু বক্কর বলেন, একই আঙ্গিনার মসজিদ ও মন্দির ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। আর এই সম্প্রীতির চিত্র নিজের চোখে দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। অনেক সময় স্থানীয়দের কাছ থেকে দর্শনার্থীরা ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ ও মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।

তিনি আরো বলেন, যুগের পর যুগ একই আঙিনায় একই সঙ্গে মুসলিম ও হিন্দুরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছেন। কিন্তু, কোনো দিনই কোনো ধরনের সমস্যা বা রেষারেষি হয়নি। আমরা উভয় ধর্মের মানুষ এখানে হাসিমুখে থাকি, ধর্ম পালন করি।

স্থানীয় ব্যবসায়ী সুকুমার রায় বলেন, একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির আর যুগের পর যুগ ধরে একই সঙ্গে চলছে ধর্মীয় আচার পালন। কিন্তু, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা পূজার্চনা করতে কোনো দিনই কোনো বাঁধার মুখে পড়েননি। মন্দিরে বড় ধরনের ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করা হলে এখানকার মুসলিম সম্প্রীতির স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশে কোথাও কোনো ধরনের ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলেও এখানে তার প্রভাব পড়েনি।

মন্দিরের পুরোহিত সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘মন্দিরে নিয়মিত পূজার্চনা হয়। আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটে এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে কোনো দিনই পড়তে হয়নি। বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি।’

লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন জানান, তিনি প্রতিদিনই এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। সময় পেলেই মন্দিরে আসা ভক্তদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

তিনি বলেন, ‘এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট ছিলো, আছে আর থাকবে। কোনো দিনই এই সম্প্রীতিতে কোনো দাগ পড়েনি আর পড়বেও না। সারাবিশ্বেও যদি ধর্মীয় সহিংসতা বাধে তবুও এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি থাকবে অটুট। এটাই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত