ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

লালমনিরহাটের ঘটনায় একাধিক মামলা হচ্ছে

  লালমনিরহাট ও রংপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২০, ২১:৩৯  
আপডেট :
 ৩০ অক্টোবর ২০২০, ২১:৪৭

লালমনিরহাটের ঘটনায় একাধিক মামলা হচ্ছে
ছেলের সাথে শহীদুন্নবী

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দরে আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী জুয়েল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় আলামত সংগ্রহ, তদন্ত কার্যক্রম এবং জিজ্ঞাসাবাদ জারি রেখেছে পুলিশ।

ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, এখনও মামলা দায়ের করা হয়নি। তবে ইউনিয়ন পরিষদ, নিহতের পরিবার ও পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিক মামলা করা হবে। ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করতে আলামত সংগ্রহ, তদন্ত ও স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবদ চলছে।

শুক্রবারপাটগ্রাম থানায় আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা জানান।

এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বুড়িমারী স্থলবন্দর জামে মসজিদে কয়েকজন কোরআন অবমাননার অভিযোগ তোলে আবু ইউনুছ মো. সহিদুন্নবী জুয়েল নামে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। পরে পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশ পুড়িয়ে ফেলেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। নিহত আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রি পাড়ার মৃত আবু ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সুলতান জোবায়ের আব্বাস (৪৫) নামের আরও এক ব্যক্তি। তিনি একই এলাকার শেখ আব্বাস আলীর ছেলে, পেশায় দলিল লেখক।

লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানায়, শহীদুন্নবীকে উত্তেজিত জনতা যখন ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষের দরজা ভেঙে বের মারধর শুরু করে, তখন পুলিশ তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। তবে শহীদুন্নবীকে রক্ষা করা যায়নি। তবে তার সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তিকে পুলিশ উদ্ধার করে।

এ বিষয়ে মামলার প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি, তবে সবকিছু প্রক্রিয়াধীন। প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।

বুড়িমারী স্থলবন্দর জামে মসজিদের খাদেম জোবেদ আলী বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, মসজিদের খাদেম জোবেদ আলী জানান, আবু ইউনুছ মোঃ সহিদুন্নবী জুয়েল নামে ওই ব্যক্তি প্রথমে আসরের নামাজ আদায় করেন। তিনি নিজে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে মসজিদের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র ও জঙ্গি খুঁজতে থাকে। তিনি কোরআনের ওপর পা দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে মসজিদের বারেন্দা থেকে এক ব্যক্তি তাকে মসজিদের বাহিরে নিয়ে গিয়ে জুতা খুলে মারধর করেন। মুহূর্তে শত শত লোক জড়ো হয়। পরে হাফিজুল ইসলাম নামে এক ইউপি সদস্য এসে তাকে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়।

মসজিদের ঈমাম সৈয়দ আলী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি যখন মসজিদ থেকে বের হই, তখন ওই ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করেন। তার আচরণ দেখে আমার ভারসাম্যহীন মনে হয়েছে।

লালমনিরহাট ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি ওই মসজিদ পরিদর্শন করেছি। ঈমাম, খাদেম ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, গুজব ছড়িয়ে ওই ব্যক্তি হত্যা করা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ জার্নালের রংপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আবু ইউসুফ মো. শহীদুন্নবীর পরিবার জানায়, জুয়েল ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজেরে লাইব্রেরিয়ান ছিলেন শহীদুন্নবী। সর্বশেষ প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি বেতন পেতেন তিনি। নিজই চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়ার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। দিনে দিনে ভারসাম্যহীন হয়ে উঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই মেধাবী।

রংপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জুয়েলকে হত্যার ঘটনায় মাতম চলছে নগরীর শালবন নবীভিলায়। কে কাকে শান্তনা দেবে এই পরিস্থিতি নেই সেখানে। স্ত্রী, বাবা হারা দুসন্তান, বোন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় যেন আকাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন কেউ কেউ।

স্থানীয় অনেকেই জানান, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে মাঝেমধ্যে অসংলগ্ন কথা বলতেন ইউসুফ মো. শহীদুন্নবী। কখনো কখনো পাড়ার বিভিন্ন বাসায় গিয়ে পরিচিত-অপরিচিতদের নিজেকে ডিজিএফআই, এনএসআইসহ নানা পরিচয় দিতেন। গরমের সময়ও শীতকালীন জ্যাকেট পরিধান করতেন তিনি। মাঝে মাঝেই লোকদের বলতেন, 'তুমি কি ভাবো, আমি এই জ্যাকেট কেন পড়ছি? এখানে সেই জিনিস আছে, যা গোয়েন্দারা রাখে।'

স্থানীয়রা আরও জানায়, ধর্ম অবমাননা বা পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননার অভিযোগে তাকে পুড়িয়ে মারা হলেও তিনি ছিলেন অত্যান্ত বিনয়ী নম্র এবং খোদাভীরু। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করাসহ শুদ্ধভাষায় কোরআন তিলোয়াত করতে পারতেন। এছাড়াও তিনি সততা ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে গিয়ে জামাতের নামাজ আদায় করতেন।

এ ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত জুয়েলের পরিবার স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের বরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

শহীদুন্নবীর ছোট বোন ইসমত আরা লতা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। ১৯৯৬ সালে রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজে গ্রন্থাগারিক পদে চাকরি নেন। তিনি সেখানে সর্বশেষ প্রায় এক লাখ টাকার মতো বেতন পেতেন। তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র নাকি হয়েছে। এ কারণে ভাইয়া ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চাকরি থেকে অব্যহতি নেন। কিন্তু কী কারণে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যহতি নেন তা আমরা জানি না। শুধু বলতো আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়েছে। ওই চাকরি যাবার পর তার অনেকটা আয় বন্ধ হয়ে যায়। তার জীবন এলোমেলো হতে শুরু করে। অবশেষে ভাইয়ে পুড়িয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া হলো। আমি এর বিচার চাই।’

শহীদুন্নবীর বড় বোন হাসনা আক্তার বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘ওর চাকরি যাবার পর মানকিভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলতো, আর বলতো আল্লাহ কেন আমার মৃত্যু দেয়নি সেদিন। আমার চাকরি না গিয়ে যদি ওইদিন মৃত্যু হতো তাই ভালো ছিলো। আমি বলতাম, চাকরি নাই তো কি হয়েছে, জীবন তো আছে। জীবনের চেয়ে কি চাকরি বড়। চিন্তা করিস না প্রয়োজনে আমার ভাগের জমি তোকে লিখে দেবো, তুই চিন্তা করিস না। তোর দুটি সন্তান আছে তাদের মানুষ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘চাকরি যাবার পর সে অনেক ভেঙে পড়ে। আমি ওকে আমার ভাগের সম্পত্তি দিয়ে দিতাম। ওকে কেন এভাবে মারলো, আমি বিচার চাই।’

শহীদুন্নবীর স্ত্রী জেসমিন আরা মুক্তা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘সে আমার স্বামী। সে কতো ভালো আমি সেটা জানি। জুয়েলকে (শহীদুন্নবীর ডাক নাম) এনে দেন। আমি ওকে একবার দেখি। ওরা এভাবে কেন মারলো..কেন মারলো। ও সবকিছু ভুলে যায়। সবাই বলতো ও অনেক ভালো ছিলো। জুয়েলের মতো মানুষ হয় না।’

শহীদুন্নবীর খালাতো বোনের স্বামী রাশেদুল বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘মানসিক সমস্যা ছিলো। গতকাল বৃহস্পতিবার জুয়েল তার বড় বোনকে বলেছে, ‘ডিসির সঙ্গে আমার একটা গোপন বৈঠক আছে। এই শহরে কোথায় কোথায় কি আছে তা ডিসিকে বলতে হবে। এটা আমার দায়িত্ব।’ জুয়েল সহজ সরল ছিলো। কিন্তু তাকে এভাবে হত্যা করা হবে, এটা আমরা কখনই মানতে পারছি না।’

প্রসঙ্গত, শহীদুন্নবীর বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে হলেও তারা দীর্ঘদিন থাকতেন রংপুরের শালবন এলাকায় রংপুর সরকারি রোকেয়া কলেজের বিপরীতে নবী ভিলায়। অত্যান্ত সাদামাটা জীবন যাপনকারী জুয়েলের ঘরে স্ত্রী মুক্তা ছাড়াও বড় মেয়ে জেবা তাসনিক অনন্যা রয়েছেন। তিনি রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। আর ছোট ছেলে আবু তাহের মো. আশিকুন্নবী অরন্য পড়তো একই প্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত