ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড পরিকল্পিত না দুর্ঘটনা?

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২০, ২১:২৭  
আপডেট :
 ২৭ নভেম্বর ২০২০, ০১:০৪

বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড পরিকল্পিত না দুর্ঘটনা?
নগরের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড। ছবি: সংগ্রহ।

রাজধানীর তিনটি বস্তিতে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলছেই। মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে এসব ভয়াবহ আগুন সত্যি সত্যিই দুর্ঘটনা না এর পেছনে অন্যকোনো কারণ রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ধারণা, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এসব আগুন লেগেছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের এই সরল কারণ মানতে রাজি নন ক্ষতিগ্রস্তরা। তাদের দাবি, এসব ঘটনার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। সব ঘটনাই পরিকল্পিত। দুই দিনের ব্যবধানে তিন বস্তিতে পরপর আগুন লাগার কারণ নিয়ে এভাবে ফায়ার সার্ভিস আর ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা মুখোমুখি অবস্থানে এসেছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিকভাবে কর্মপরিচয় নীচু হওয়ায় বস্তিবাসীদের কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ফলে, আগুন লাগার পরে নানা রকম দুর্ঘটনামূলক কারণ প্রতিষ্ঠা পায়। অথচ এসব বস্তি ঘিরেই রয়েছে প্রভাবশালী মহলের নানা রকম স্বার্থ।

গেল ২৩ নভেম্বর মধ্যরাতে মহাখালীর সাততলার বটতলা মসজিদ রোডের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় আড়াই শতাধিক ঘর। তাতে সর্বস্ব হারান ঘরগুলোর বাসিন্দা নিম্নআয়ের মানুষ। পরদিন বিকেলেই মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লায় বিজলী বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে যায় শতাধিক ঘর। আর সেই অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই রাত ২টার পর কালশীর বাউনিয়া বাঁধ বি ব্লকের বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় অর্ধশত ঘর ও ১২টি দোকান।

অগ্নিকাণ্ডের পর এসব বস্তির চিত্র পাল্টে যায়। শুধু মাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বস্তির বাসিন্দারা পরিণত হয় শরণার্থীতে। পরনের যার যা ছিল সেসব ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেননি কেউ।

মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায় বিহারি ক্যাম্প বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাসিন্দাদের দাবি, একটি খালি ঘর থেকে আগুন পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। এটা পরিকল্পিতভাবে কেউ করেছে। কারণ এত দ্রুত বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।

অন্যদিকে, কালশী বস্তিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার গ্যারেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে দাবি স্থানীদের। তারা বলছেন, রাতে ওই গ্যারেজে অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গেল চার বছরে রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে ১২৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০ জন আহত এবং তিনজন নিহত হন। বস্তিগুলোতে ১২৩টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮৩ টাকার। টাকার অংকে উদ্ধারের পরিমাণ ১৯ কোটি ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

বস্তিতে দফায় দফায় আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন গণমাধ্যমকে বলেন, রাজধানীর প্রায় বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ থাকে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, গ্যাস লাইন লিকেজ বা সিলিন্ডার লিকেজ, সিগারেটের আগুন বা মশার কয়েল থেকে, আবার অজ্ঞাত কারণেও আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে। একেক বস্তিতে একেক কারণে আগুন লাগে। তদন্ত করেই বস্তিতে আগুনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে বলা যাবে বলে জানান তিনি।

একই রকম কারণ দেখিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, এর আগে তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে আগুন যে লাগানো হয়, তা-ও অমূলক নয়। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে কোনো মহলের ইনফ্লুয়েন্স তো থাকেই।

সম্প্রতি তিনটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অস্বাভাবিক মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, দুদিনে তিন বস্তিতে আগুন লেগে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক বা ছোট ঘটনা নয়। অনেক সময় বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য এমন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে আগুনের সূত্রপাত বের করাটা জরুরি।

আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তৎপরতা। ছবি: সংগ্রহ।

এই নগর বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, সিটি করপোরেশনে বস্তি উন্নয়ন নামে একটি বিভাগ আছে। তারা বস্তি নিয়ে কাজ করেন। তারা এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন কিনা জানি না। তাদের উচিত এই বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষের দায়িত্ব নেওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি উচ্ছেদ করা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সামাজিকভাবে কর্মপরিচয় নীচু হওয়ায় বস্তিবাসীদের কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ফলে, আগুন লাগার পরে শর্টসার্কিট, গ্যাস লিকেজ, সিলিন্ডার বিস্ফোরণসহ নানা রকম দুর্ঘটনামূলক কারণ প্রতিষ্ঠা পায়। অথচ প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে স্বার্থান্বেসী মহল জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে এ ঘটনাগুলো ঘটাতে পারে। অল্প সময়ে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো সরলিকরণ না করে একটু তদন্ত করলেই বেড়িয়ে আসবে নেপথ্যের কারণ।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, সাধারণত বস্তিগুলো পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় ভূমি মালিক জমি খালি করার জন্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত