ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

সংরক্ষিত বন উজাড় করে খাসিয়াদের পান চাষ!

  মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৬

সংরক্ষিত বন উজাড় করে খাসিয়াদের পান চাষ!
সংরক্ষিত বন উজাড় করতে মরিয়া খাসিয়ারা। ছবি: প্রতিনিধি

হুমকির মুখে পড়েছে কুলাউড়ার বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র। সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে খাসিয়ারা পান চাষের নামে নির্বিচারে উজাড় করছে বন। এ সংরক্ষিত বন রক্ষা করতে একাধিক বার হামলার শিকার হতে হয়েছে বন বিভাগের কর্মীদের। আর খাসিয়াদের চতুরতায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

বন উজাড়ের এমন দৃশ্য দেখা যায় কুলাউড়া উপজেলার কমর্ধা ইউনিয়নে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।এ ব্যাপারে চরম উদাসীন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

কর্মধা ইউনিয়নের নলডরী বনবিট সূত্র জানায়, নলডরী বিটের অধীনে ৪টি মৌজায় প্রায় ২৪৬৮.৫৪ একর সংরক্ষিত বনভূমি ছিল। এরমধ্যে বিভিন্ন সময়ে খাসিয়ারা ১৯৩৭.১২ একর জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই জায়গা দখল করে পান চাষে নামে গাছের ডালপাল উজাড় করে বিরানভূমিতে পরিণত করেছে। বাকি বাঁশ মহাল থাকা ৫৩১.৪২ একর জায়গাটুকু দখল করতে এখন লেগেছে উঠেপড়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বন বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে জবরদখল করে খাসিয়ার স্থাপন করেছে কয়েকটি পান পুঞ্জি। একেক পান পুঞ্জিতে ৩০/৩৫ পরিবার আবার কোনো কোনো পুঞ্জিতে ৫০/৬০টি পরিবার গৃহনির্মাণ করে আলিশান জীবনযাপন করছেন। তাদেরকে কোন সরকারি খাজনা, ট্যাক্স কিছুই দিতে হচ্ছে না। যেনো তাদের নিয়মেই চলে পুঞ্জির সবকিছু।

একেক খাসিয়া শত শত একর জায়গায় পান চাষ করে পান বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা মাসিক উপার্জন করছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার দেশের কোনো ব্যাংকে তারা টাকা সঞ্চয় করে না। পান বিক্রি বাবত উপার্জিত লাখ লাখ টাকা পাচার করে ভারতে। ভারতে একেক খাসিয়ার জমি, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

পান চাষের খাসিয়ারা নষ্ট করছে বনের সৌন্দর্য্য। এক সময় পাহাড়ে বেশ কয়েকটি বাঁশ মহাল ছিল। বাঁশ মহাল ইজারা দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেতো। কিন্তু বাঁশ মহালে পান না হওয়ায় সেই বাঁশ মহালগুলো কেটে তাদের দখলে নিয়ে গেছে পান গাছে যাতে ছায়া না ধরে সেজন্য শত বছরের পুরনো গাছে মাথাসহ ডালপাল কেটে ফেলে। বিষ দিয়ে ঘাষ ও লতা-পাতা কেটে পেলে।

ফলে হারিয়ে গেছে বনাঞ্চলের হরিণ, বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণীদের আনাগোনা ছিলো। কিন্তু পাহাড় উজাড় করে পান চাষ ও বসতি স্থাপন এবং বন্য প্রাণী শিকার করে খেয়ে ফেলার কারণে বর্তমানে জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে।

এদিকে ১৬ নভেম্বর নলডরী বনবিটের অধীনে লবনছড়া বাঁশ মহালে ২৫-৩০ জন খাসিয়া মিলে ৩৫ একর বাঁশ কাটার খবর পেয়ে বন বিভাগ অভিযান চালায়। অভিযান টের পেয়ে অন্য খাসিয়ারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নুনছড়া পানপুঞ্জির করডর খাসিয়ার ছেলে স্টেপ খাসিয়াকে আটক করতে সক্ষম হয় বন বিভাগ।

এরপর ২১ নভেম্বর শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের এসিএফ জিএম আবু বক্কর সিদ্দিক ও মুরইছড়া বন বিট কর্মকর্তা, নলডরী বিট কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্জুন কান্তি দস্তিদার নেতৃত্বে বনকর্মীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। এ সময় তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে সঙ্গে নেন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বনবিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত দুই সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের।

বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায় খাসিয়ারা। তাদের সহযোগিতা করেন পুঞ্জির কয়েকজন বাঙালী চৌকিদার। খাসিয়াদের হামলায় আহত হন নলডরী বন বিভাগের কর্মী আকরাম হোসেন, সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী আমির আলী, জিয়াসহ আরো ৫ জন।

পরে তাদের উদ্ধার করে কুলাউড়া হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। ওইদিনই বিট অফিসার অর্জুন কান্তি দস্তিদার বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন।

অন্যদিকে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে খাসিয়া। তারা মিথ্যে পান কাটার অভিযোগ এনে স্থানীয় বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে কুলাউড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে।

এ প্রসঙ্গে বিট কর্মকর্তা অর্জুন কাস্তি দস্তিদার বলেন, সংরিক্ষত বনাঞ্চলের পুরোটাই বাঁশ ও গাছপালায় ভরপুর ছিলো। কিন্তু খাসিয়ারা পুরো বনকেই উজাড় করে ফেলেছে। খাসিয়াদের প্রধান শত্রু বাঁশ। তারা চায় না পাহাড়ে বাঁশ থাকুক। তাই বাঁশ কেটে উজাড় করে দিচ্ছে। গাছ থাকলেই গাছের ছায়ায় পান না হওয়ায় তারা গাছের মাথা ও ডাল কেটে দেয়। ১-২ বছর পর পর গাছের মাথা ও ডাল কেটে দেয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুঞ্জিতে স্থায়ীভাবে স্থাপনা তৈরি না করতে পারে সেজন্য রড, সিমেন্ট কিংবা বালু তুলতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে।

বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপকার ভোগীরা তাদের বনায়ন দেখাশুনা করবে। সামাজিক বনায়নের বিধিমালায় আছে সাধারণ জনগণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা করবে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু খাসিয়ারা চায় না আমাদের সঙ্গে পাবলিক থাকুক। তাই তারা উপকারভোগী ও সাধারণ জনগনের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। ওই আমরা সঙ্গে ছিলাম। কেউই তাদের বনায়নের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যদি পাবলিকদের মামলা দিয়ে হয়রানি করে তাহলে মামলার ভয়ে পাবলিক আমাদের সঙ্গে থাকবে না। আর আমরা জনবল কম থাকায় তাদের সঙ্গে পারবো না।

তিনি বলেন, আমি এই বিটে যোগদান করার পরই দেশের সম্পদ পাহাড় রক্ষার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা করছি। সব সময়ই পাহাড় কাটার প্রতিবাদ করেছি। বিভিন্ন সময় খাসিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তাই আমাকে এখন থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য খাসিয়ারা চেষ্টা করছে।

শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের এসিএফ জিএম আবু বক্কর সিদ্দিক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, খাসিরায়া আমাদের উপর হামলা করে। থানায় অভিযোগ দিয়েছি। কুলাউড়া থানার ওসি বিনয় ভূষন রায় জানান, লবনছড়ার ঘটনায় খাসিয়া এবং বনবিভাগ পরস্পরকে দায়ী করে থানায় মামলা দায়ের করেছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত