এসআই মহিউদ্দিনের কাছে ‘জিম্মি’ ছিলো পুরো রূপাতলী
সালেহ টিটু, বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৯:১৯ আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৯:৫৪
শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে হত্যার অভিযোগের তিনদিন পর বরিশাল মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এসআই মহিউদ্দিন মাহিকে তার কর্মস্থল থেকে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে তাকে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়।
এদিকে এ ঘটনার পর থেকে এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে।
এসআই মহিউদ্দিনের নগরীর রূপাতলী এলাকার শেরেবাংলা সড়কে রয়েছে বহুতল ভবন। এ কারণে অত্র এলাকার মানুষ তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। মহিউদ্দিনের হয়রানির থেকে রক্ষা পেতে আইজিপি থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ কমিশনার, দুদক ও ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছিলো ভুক্তভোগীরা।
নিহত শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজাও ওই এলাকার বাসিন্দা। আর এ কারণে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী এসআই মহিউদ্দিনের ফাঁসির দাবিতে রেজার লাশ নিয়ে বিক্ষোভও করে।
এদিকে এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে জোরপূর্বক জমি দখলেরও একাধিক অভিযোগ।
আরো পড়ুন: এবার ‘রায়হান স্টাইলে’ যুবককে হত্যার অভিযোগ
নগরীর রূপাতলীর শেরেবাংলা আদর্শ সড়কের বাসিন্দা ও শিক্ষিকার ছেলে মুদি ব্যবসায়ী মো. রুবেল বলেন, আকস্মিকভাবে এসআই মহিউদ্দিন একদিন আমার মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে দোকানে ইয়াবা বেচাকেনার অভিযোগের কথা বলে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, এ অভিযোগ সত্য নয়। তার (এসআই) সাফ কথা 'তুই ইয়াবা ব্যবসা করিস দোকান খুলবি না। দোকান খুললে তোকে গ্রেপ্তার করবো।'
রেজার লাশ নিয়ে বরিশাল নগরীতে বিক্ষোভ
তিনি বলেন, এরপর এসআই মহিউদ্দিন রাতে বাসায় গিয়ে আমার মা নগরীর ছকিনা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হাসিনা বেগমের কাছে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে আমাকে গালমন্দ করে। পরবর্তীতে আমি মহিউদ্দিনের বাসভবনে গিয়ে তার পায়ে ধরে দোকান খোলার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে দোকান খোলার অনুমতি দেননি। উল্টো তার সাথে থাকা এক আত্মীয় আমাকে এক লাখ টাকা দেয়ার জন্য বলেন।
রুবলে আরো বলেন, আমি দোকান দিয়েছি বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ উত্তোলন করে। দোকান বন্ধ থাকায় আমার আয় বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি পুলিশ কমিশনারসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে জানালেও কোন কাজ হয়নি।
রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার মৃত মোবারক আলী মোল্লার ছেলে মাহাবুব মোল্লার বিরুদ্ধে এসআই মহিউদ্দিন মিথ্যা মামলা ও ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমিক দেন। উকিলবাড়ি সড়কের মাহাবুবদের জমি দখলের চেষ্টা করছিল মহিউদ্দিন। তখন বাধা দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয় মহিউদ্দিন। এরপর মাহাবুব মোল্লা তৎকালীণ পুলিশ কমিশনার শৈবাল কান্তি চৌধুরীর নিকট লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর এসআই মহিউদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি মাহাবুব মোল্লা মারা যান।
আরো পড়ুন: সেই এসআই’র বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা
রূপাতলী সোনারগাঁও টেক্সটাইল এলাকায় হানিফ মিরার ছেলে রফিক মিরা, মুনসুর মিরা ও মনির মিরাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে থানায় নিয়ে আটকে রেখে মারধর করে এসআই মহিউদ্দিন। পরে তাদের জমি দখল করে নেয়।
রূপাতলীর বাসিন্দা মো. আরিফ বলেন, এসআই মহিউদ্দিন আমার পৈত্রিক ওয়ারিস সূত্রে পাওয়া চার শতাংশ জমি দখল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সেজন্য আমাকে হুমকি-ধামকি এবং মিথ্যা মাদক মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এমনকি আমার বাসায় এসে আমাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে বলে, 'তোকে মেরে ফেলবো তুই ওই জমির কাছে যাবি না।' আমি ডাক চিৎকার করলে আমার বাড়ির লোকজন ছুটে আসলে মহিউদ্দিন আমাকে ছেড়ে দেয়। পরে মহিউদ্দিন আমাকে গালাগাল করতে করতে বাসার সামনে থেকে চলে যায়।
রেজাকে ধরে নিয়ে ছবি তুলে এভাবেই ফেসবুকে দেন এসআই মহিউদ্দিন
আরিফ বলেন, সিভিল পোশাকে আসলেও মহিউদ্দিনের কাছে পিস্তল ও ওয়ারলেস ছিলো। নানী বুড়ি মাজার এলাকা থেকে নুরুন্নবী তালুকদারের ছেলে মাহাবুব রহমান হিরু তালুকদারকে ৬ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে এসআই মহিউদ্দিন। এরপর থানায় হস্তান্তর করে। পরদিন ওই মামলায় আমাকে (আরিফ) পলাতক আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে।
রূপাতলীর সালাম খন্দকার বলেন, এসআই মহিউদ্দিন একটি চুরির মিথ্যা মামলায় আমার ছেলে ইব্রাহীমকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর মোটা অংকের টাকা চায়। ওই টাকা দেয়া হলেও সে তাকে মামলায় চালান দেয়।
এভাবে রূপাতলী এলাকার বহু মানুষ তার কাছে হয়রানির শিকার হয়েছে। তার অত্যাচারে বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দেয়া হলেও কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, এসআই মহিউদ্দিন শেরেবাংলা সড়কের ধাবারী জামে মসজিদের সভাপতি হতে এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মুসুল্লিরা তার ঘুষের টাকা নিতে অস্বীকার করে। আর টাকা নিলেও তা দিয়ে প্রসাবখানা নির্মাণের কথা বললে ক্ষুব্ধ হন এসআই মহিউদ্দিন। এজন্য তিনি ওই মসজিদের সভাপতির সাথে খারাপ আচরণ করেন এবং দেখে নেয়ার হুমকি দেন।
এদিকে এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে রয়েছে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি। নগরীর রূপাতলী চান্দু মার্কেট শেরেবাংলা সড়কে রয়েছে তার চারতলা ভবন। ভবনের বাহিরে তেমন একটা চাকচিক্য করা না হলেও তার ভেতরের চাকচিক্যতা দেখলে যে কেউ হতবাক হবে। অনেকেই বলছেন, নিয়মতান্ত্রিক বেতন দিয়ে কোনভাবেই ওই ধরণের বহুতল ভবন করা সম্ভব নয়।
এছাড়া রূপাতলী পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের পেছনে আবাসিক এলাকায় ৩৫ শতাংশ জমি, রূপাতলী উকিলবাড়ি সড়কে রফিক মেম্বরের বাড়ির পিছনে ১০ শতাংশ জমি বোনের নামে, র্যাব অফিসের পেছনে মহিউদ্দিনের নামে ৩২ শতাংশ জমি, বটতলা স্কুলের পেছন ১০ শতাংশ জমি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় বড় একটি প্লট রয়েছে। ভাই জসিম, বোন ও স্ত্রীর নামে এসব জমি করা হয়েছে।
স্পর্শতাকর উল্লেখ কিছুই বলতে রাজি হননি শের-ই-বাংলা মেডিকেলের পরিচালক
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই মহিউদ্দিন মাহি নিউজটি না করার অনুরোধ করেন। এমনকি সংবাদমাধ্যমে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে মোবাইলে কল করে নিউজটি বন্ধের অনুরোধ জানান।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজাকে নগরীর হামিদ খান সড়ক থেকে ধরে নিয়ে যায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মহিউদদ্দিন। ৩০ ডিসেম্বর তাকে একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
১ জানুযারি রাত সাড়ে ৯টায় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে কারা হাসপাতাল ও পরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ২ জনুয়ারি রাত ১২টা ৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রিয় কারাগারের জেলার শাহ আলম জানিয়েছিলেন, শরীরিক ক্ষত নিয়ে জেলখানায় পাঠানো হয়েছিলো রেজাউলকে।
তবে স্পর্শকাতর উল্লেখ করে এ ঘটনায় কিছুই বলতে রাজি হননি শের-ই বাংলা মেডিকেলের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে নিহত রেজার বাবা বাদী হয়ে এসআই মহিউদ্দিনসহ অজ্ঞাতনামা আরো ২ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। বরিশালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. আনিছুর রহমান ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পিবিআই'র একজন পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
ঘটনার পর বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান ঘটনার বলেছিলেন, এ ঘটনা তদন্ত করে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজ মঙ্গলবার তিনি জানান, প্রশাসনিক কারণে উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন মাহিকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনস এ সংযুক্ত করা হয়েছে।
নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর সাগরদী হামিদ খান সড়কের পাশের একটি চায়ের দোকানে বসা ছিলো রেজাউল করিম। এ সময় নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন তাকে মাদকের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করে। তার কাছ থেকে ১৩৮ গ্রাম গাঁজা এবং ৪ পিস নেশাজাতীয় ইনজেকশন উদ্ধারের দাবি করে ওইদিন রাত সাড়ে ১১টায় কোতোয়ালী মডেল থানায় মামলা করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে