ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

বরই চাষে ভাগ্য বদলে গেছে দুলালের

  দেওয়ান আবুল বাশার

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:৪১

বরই চাষে ভাগ্য বদলে গেছে দুলালের

এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করে কৃষিতে ঝুঁকে পড়েন দুলাল। অনেকটা শখের বশে কাজ শুরু করলেও সেই শখই এখন পেশায় পরিণত করেছেন। সংসারের অভাব দূর করে এখন তিনি এলাকার রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন। মাত্র ২ বিঘা জমি নিয়ে বাগান শুরু করে পরিশ্রমের ফলে এখন তা ১০ বিঘার অধিক বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে দুলাল লাখপতি, অভাবের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।

এমন সফল ফলচাষি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার উকিয়ারা গ্রামের মো. দুলাল মিয়া। তার বাবার নাম মেহের আলী।

দুলাল মিয়া সংসারকে মনে করেছেন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। তাই দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ হয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে সফল ফলচাষি। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে তিনি ১০ বিঘা জমি বাড়িয়েছেন। থাকার জন্য সুন্দর একটি বসতবাড়ি তৈরি করেছেন। বর্তমানে নিজের ও লিজ নেয়া মিলে ১০ এর অধিক বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফলের চাষ রয়েছে তার।

এ বছর তিনি ভারতীয়, কাশ্মিরি, নারিকেল, আপেল, বাউ ও থাই কুলের চাষ করেছেন। ইতিমধ্যেই বরই পাকা শুরু করেছে। বাগান থেকেই পাইকারি দরে মণ হিসেবে ব্যাপারিদের কাছে বিক্রি করেন, যা জেলা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেয়া হচ্ছে।

তার দেখাদেখি এ অঞ্চলের অনেকে এখন বরই চাষ শুরু করেছেন। তার বাগানে রয়েছে বল সুন্দরী জাতের বরই, যা সবার নজর কেড়েছে। অতীত ও বর্তমান জীবনের হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে এলাকার মানুষের কাছে তিনি জীবনযুদ্ধে জয়ী সফল এক যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

বরই চাষে ভাগ্য বদলে গেছে দুলালের

সরেজমিনে দুলালের বরই বাগানে গেলে দেখা যায়, মাটির সামান্য ওপর থেকেই সব কুল গাছের ডালপালা চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি ডালে প্রচুর পরিমাণে কুল ধরে মাটিতে নুয়ে পড়ছে। অবস্থাটা এমন যে, গাছের পাতার চেয়ে গাছে কুল বেশি দেখা যাচ্ছে।

কুলগুলো দেখতে ঠিক অস্ট্রেলিয়ান আপেলের মতো। কিন্তু আকারে একটু ছোট। পাখি ঠেকাতে সারা ক্ষেতের ওপর দিয়ে নেট জাল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এতে কোনো পাখিই আর ক্ষেতের কুল নষ্ট করতে পারছে না।

ওই মাঠের একটু দূরে আরেকটি ক্ষেতে রয়েছে একই জাতের কুল। সে ক্ষেতটিতেও আপেল কুলের পাশাপাশি চাষ করা হয়েছে বল সুন্দরী জাতের কুল। এ ক্ষেতটিতে কুলের ধরটা আরও বেশি। রঙটাও বেশ আকর্ষণীয়। এর অল্প দূরেই থাইল্যান্ডের-৫ ও ৭ জাতের পেয়ারা। পেয়ারা ক্ষেতের পাশেই রয়েছে থাইল্যান্ডের বারোমাসি জাতের আম। যেখানে ছোট ছোট আম গাছে মাটি থেকে একটু ওপরে ছোট-বড় আম ধরে আছে। আবার কিছু কিছু আমগাছে সবেমাত্র মুকুল আসছে। সব ফলের ক্ষেতই আগাছামুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ক্ষেতের ফলগুলো এবং ক্ষেত দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

ক্ষেতেই দেখা হয় কৃষক দুলালের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাংসারিক জীবনে অভাবের তাড়নায় খুব কষ্ট করেছেন। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল পরিশ্রম করেই সফল হবেন। অর্থ না থাকলেও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ২০০০ সালে প্রথমে কিছু ধারদেনার মাধ্যমে দুই বিঘা জমিতে বরই চাষ শুরু করেন। সেখান থেকেই শুরু, এখন তার পাঁচটি বাগান। এর বাহিরে তার লিচু বাগান ও ধানের প্রজেক্টও রয়েছে। সেখানেও তিনি সফলতার ছাপ রেখছেন।

অন্যান্য চাষের চেয়ে বরই চাষে লাভ বেশি পেয়ে জমি বর্গা নিয়ে বরই চাষ বাড়াতে থাকেন তিনি। আর এভাবে ২০ বছর বরই চাষের মাধ্যমে বেশ সফল হন তিনি। এরপর নানা জাতের চারা উৎপাদন করলে সেখানেও সফলতা ধরা দেয়।

কৃষক দুলালের ভাষ্য, এ পর্যন্ত জীবনে যত ফল ও ফসলের চাষ করেছেন, প্রায় সবই লাভবান হয়েছেন। কিন্তু বেশি সাড়া জাগিয়েছে বল সুন্দরী ও আপেল জাতের কুল। ক্ষেতে যে পরিমাণে কুল ধরেছে, তা দেখতে মানুষ আসছে। অন্য কৃষকরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। গাছের শাখা-প্রশাখায় তারার মতো ধরে আছে বরই। অবস্থাটা এমন, পাতার চেয়ে বরই বেশি।

দুলালের বাগানে অনেক জাতের কুল চাষ হয়েছে; কিন্তু বল সুন্দরী জাতের কুল চাষ এই প্রথম। এ জাতের কুলের আকার, রঙ ও ধরার দৃশ্যটা বেশ ভিন্ন। বল সুন্দরী কুল দেখতে অস্ট্রেলিয়ান ছোট আপেলের চেয়ে একটু ছোট। কিন্তু স্বাদে কড়া মিষ্টি। কুল বয়সে পরিপূর্ণ হয়েছে। এখন এসব ক্ষেতের কুল বিক্রি উপযোগী হয়ে উঠেছে।

কৃষক দুলাল আরও জানান, তার বাগানে মাসিক চুক্তিতে ১০/১২ জন লোক সারা বছর কাজ করে। কোনো কোনো সময় বাজারজাতও তারা করেন। তারা অনেক ভালো বলেই বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। বিনিময়ে তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলোও নিজের মতো করে দেখি। স্ত্রী ও দুই সন্তানও তাকে সহাযতা করেন।

জাগির ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা কল্পনা রাণী জানান, এ এলাকায় যেন ফলের বিপ্লব ঘটে গেছে। দুলাল মিয়া অনেক পরিশ্রম করে বিভিন্ন ধরণের ফলের চাষ করেছেন। তার মধ্যে বল সুন্দরী কুল যেভাবে গাছে ধরে আছে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

একই গ্রামের ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক ইদ্রিস আলী জানান, দুলালের বাগানে আম-লিচুসহ সব মৌসুমের ফল থাকলেও বরই চাষে আলোড়ন তুলেছে। তার পাচটি বাগানে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক আসছে বাগান দেখতে। বাজারে আপেল কুলের চেয়েও দুলালের বাগানের কুল অনেকটা বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু। দুলাল বেকার যুবকের আশান্বিত করেছে। তার দেখাদেখি অনেকেই এখন কৃষিতে ঝুঁকে পড়েছে।

এতসব সফলতার মাঝেও দুলালের কষ্ট আছে। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর যাবৎ বাগান করছি, আমি জেলার সবচেয়ে বড় এবং সফল চাষি হলেও কৃষি অফিস কখনও কোনো খোঁজখবর অথবা সহায়তা করে না। বঙ্গবন্ধু পুরষ্কারসহ নানা পুরষ্কার দেবার কথা বলে প্রতি বছর কাগজপত্র নিলেও আজ পর্যন্ত কোনো সহায়তা বা পুরষ্কার পাননি। কখনও তাদের শরণাপন্ন হলে তাদের আচরণ অত্যান্ত ঢ়ূর প্রকৃতির হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে বারবার ফোন দিয়ে ও অফিসে গিয়েও উপজেলা কৃষি অফিসার আফতাব উদ্দিনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, দুলাল মিয়া নিজে একসময় কষ্ট করেছেন। আর এখন হয়েছেন এলাকার মধ্যে একজন আদর্শ কৃষক। কৃষিকাজ করে যে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানো যায়, এ কৃষক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত