ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

মহামারীতেও থামেনি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম

  মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১৪  
আপডেট :
 ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১৯:০১

মহামারীতেও থামেনি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম
ছবি- প্রতিনিধি

আজ ২৫ এপ্রিল বন্দর দিবস। ১৮৮৭ সালে পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার। ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল তা কার্যকর হয়। তখন থেকে চট্টগ্রাম বন্দর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাই প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল বন্দর দিবস উদযাপন করা হয়।

কিন্তু করোনার মহামারীর কারণে গত বছরের ন্যায় এবারও বন্দর দিবস পালনের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। নেই কোনো বিশেষ আয়োজন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছর চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনাড়ম্বরভাবে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত পালন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।

করোনা মহামারীতে পৃথিবীর অনেক কিছু থেমে গেলেও একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। করোনার ঢেউ মোকাবেলা করে সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টা বন্দরের অপারেশন কার্যক্রম সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরে গত বছরের চেয়ে এ বছর কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডিলিং এবং জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। বর্তমানে বন্দরে কোনো জাহাজ জট কিংবা কন্টেইনার জট নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৬৬টি জাহাজ এসেছিল। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৯ টিইইউস, কার্গো হ্যান্ডলিং ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪০২ মেট্রিক টন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে জাহাজ এসেছে ৩৭৬টি। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৬ টিইইউস, কার্গো হ্যান্ডলিং ১ কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮১৮ মেট্রিক টন। এক বছরের ব্যবধানে কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দর ভবন

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর করোনার প্রভাবে গত ২০২০ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ও মে মাসে কনটেইনার ডেলিভারিশূন্য হয়ে পড়েছিল, যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছিল। বিগত বছরের অভিজ্ঞতা, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা ও বন্দরের অপারেশন স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করছে বন্দরের শ্রমিক ও কর্মকর্তারা।

চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- ১৪ এপ্রিলে ৭ হাজার ৯৩৪ টিইইউস, ১৫ এপ্রিলে ৭ হাজার ৬৩ টিইইউস, ১৬ এপ্রিলে ৮ হাজার ৬৯১ টিইইউস, ১৭ এপ্রিলে ৬ হাজার ৮০০ টিইইউস, ১৮ এপ্রিলে ৬ হাজার ৮১৯ টিইইউস, ১৯ এপ্রিলে ৬ হাজার ৭৯৯ টিইইউস, ২০ এপ্রিলে ৫ হাজার ৬৯২ টিইইউস, ২১ এপ্রিলে ৫ হাজার ৫৩৩ টিইইউস, ২২ এপ্রিলে ৬ হাজার ৯৩৯ টিইইউস, ২৩ এপ্রিলে ৮ হাজার ৯০০ টিইইউস, ২৪ এপ্রিলে ৭ হাজার ৪৯৫ টিইইউস এবং ২৫ এপ্রিলে ৭ হাজার ৪১৭ টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে।

একই সময়ে কন্টেইনার ডেলিভারি হয়েছে- ১৪ এপ্রিলে ৫ হাজার ১৫১ টিইইউস, ১৫ এপ্রিলে ৩ হাজার ১২২ টিইইউস, ১৬ এপ্রিলে ৩ হাজার ৫৯৮ টিইইউস, ১৭ এপ্রিলে ৩ হাজার ৫ টিইইউস, ১৮ এপ্রিলে ৩ হাজার ৩৫০ টিইইউস, ১৯ এপ্রিলে ২ হাজার ৫৮৩ টিইইউস, ২০ এপ্রিল ৩ হাজার ৮০৪ টিইইউস, ২১ এপ্রিল ৩ হাজার ৮৭০ টিইইউস ও ২২ এপ্রিল ৩ হাজার ৫৫৯ টিইইউস, ২৩ এপ্রিল ৩ হাজার ৭৩৫ টিইইউস, ২৪ এপ্রিল ২ হাজার ৯৭৫ টিইইউস এবং ২৫ এপ্রিল ৩ হাজার ১০৬ টিইইউস কন্টেইনার ডেলিভারি হয়েছে।

গত ৫ এপ্রিল সরকারি বিধিনিষেধ শুরুর দিন থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার টিইইউস কন্টেইনার ডেলিভারি হয়েছে। এর মধ্যে ৫ এপ্রিল ৪ হাজার ১৮৪ টিইইউস, ৬ এপ্রিল ৩ হাজার ৮৭৯ টিইইউস, ৭ এপ্রিল ৪ হাজার ১৮৯ টিইইউস, ৮ এপ্রিল ৪ হাজার ৪৩৫ টিইইউস, ৯ এপ্রিল ৩ হাজার ৪৪২ টিইইউস, ১০ এপ্রিল ২ হাজার ২৯০ টিইইউস, ১১ এপ্রিল ৩ হাজার ৫৩৬ টিইইউস, ১২ এপ্রিল ৫ হাজার ২৬৯ টিইইউস ও ১৩ এপ্রিল ৫ হাজার ১৫১ টিইইউস কন্টেইনার ডেলিভারি হয়।

এর আগে গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পরও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউস। ২০১৯ সালে হয়েছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউস। ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ ও ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।

বন্দরের পরিবহন শাখার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২০২০ সালের মার্চে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়েছিল ৩৬৬টি। এ সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৯ টিইইউস, কার্গো হ্যান্ডলিং এক কোটি দুই লাখ ৬৪ হাজার ৪০২ মেট্রিক টন। অন্যদিকে চলতি বছরের (২০২১ সাল) মার্চে আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ আসে ৩৭৬টি। একই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৬ টিইইউস, কার্গো হ্যান্ডলিং এক কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮১৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় বন্দরের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরুর পর বন্দরের কার্যক্রম প্রায় একমাস বন্ধ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একদিনের জন্যও বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়নি। প্রতিবেশী বন্দরগুলোর তুলনায় বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর বেশ ভালো একটা অবস্থানে রয়েছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ১০০টি কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় ৯৮তম অবস্থান নিয়ে নিজের স্বীকৃতি অর্জন করে। মাত্র ১১ বছরে ৪০ ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৫৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এই অর্জন বর্তমান সরকারের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই প্রতিফলন।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বন্দরের আধুনিকায়ন, যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও নিউমুরিং ওভার ফ্লো ইয়ার্ড নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তাবায়নের কাজ চলমান রয়েছে।

এছাড়া শুধু গতবছরেই বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে শূন্য পাইরেসি (দস্যুতা), লয়েড লিস্টে ৬ ধাপ এগিয়ে ৬৪ হতে ৫৮ তে উন্নীত হওয়া, পরীক্ষমূলকভাবে ভারতের কলকাতা বন্দর হতে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য ট্রানজিট (পণ্য পরিবহন) চালু করে নতুন রেকর্ড করেছে।

এই উল্লেখযোগ্য অর্জনের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়নে পরিকল্পনা কমিশন চট্টগ্রাম বন্দরের নেতৃত্ব ও ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে, একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে মন্তব্য করে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অনাড়ম্বরভাবে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বন্দর দিবসটি পালন করছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর এক কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতেও চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা দেশের সাপ্লাই চেইন নির্বিঘ্নে রাখার স্বার্থে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, বন্দর ব্যবহারকারী সব স্টকহোল্ডারের আন্তরিক সহযোগিতা ও চবক এর নানা পদক্ষেপের ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। বর্তমানে বন্দর অভ্যন্তরে কোনো জাহাজ জট বা কনটেইনার জট নেই। আমদানিকারকরা দ্রুততম সময়ে তাদের আমদানি পণ্য খালাসের মাধ্যমে বন্দরকে করোনার এ পরিস্থিতিতেও বন্দরের কার্যক্রম আরও নির্বিঘ্নে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন। ফলে বহির্বিশ্বে দেশের ও চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

উল্লেখ, ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৬০ সালে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৮ সালে ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেলওয়ের সংযোগ হয়।

১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টে পরিণত করা হয়। বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টকে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটিতে পরিণত করা হয়। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত