ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

মেরিদের গল্প অনেকেরই অজানা

  মো. ফরহাদ উজজামান

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ২০:৩৭

মেরিদের গল্প অনেকেরই অজানা
ছবি: সংগৃহীত

কিছু মানুষের জীবনের গল্প শুরুই হয় তার আপন মানুষের দ্বারা প্রতারিত হয়ে। ঠিক এমনই একজন যৌনকর্মী মেরিনা আক্তার। ছোট থেকেই বাসা বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মাত্র ৯ বছর বয়সেই কালিবাজার ছাপরার একটা যৌনপল্লীতে নিজের বড় বোন বিক্রি করে দেন তাকে। এরপর থেকে সেখানেই আছেন মেরি।

নিজের জীবনের এমন গল্প বলার সময় অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাগোর জীবনের এই গল্প শুইনা কী অইবো? সব বন্ধ কইরা দিছে। একবেলা খাবার যোগাতেও পারছি না। আমাগো মতো মানুষ দেহার কেউ নেই। কী এক ভাইরাস আইলো রাস্তায় নামা নিষেধ। রোগ ছড়াইবো আমাগো কাছে আইলে? কিন্তু পেটে তো খাওন দিতে অইবো!’

নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর রেলস্টেশন দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান যৌনপল্লী। এখানে দিনরাত খদ্দেরদের আনাগোনা লেগেই থাকে। চলমান মহামারীতে জায়গাটি এখন একেবারেই শুনশান, নিস্তব্ধ। রাস্তায় তারা এখন কোন খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে না। বরং বেশি অপেক্ষা করে কখন কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের খাবার দিতে আসবে!

মেরিনা আক্তারের সংসারে দুই সন্তান। স্বামী একাধিক বিয়ে করেছে। এ ছাড়া উপার্জন করে হাতে টাকা তুলে না দিলে নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হতো। তাই আর সংসার করা হয়ে উঠেনি। মেরিনা আক্তার বলেন, ‘দুই পোলাও বাপের মতো স্বভাব, কামাই করে টেকা না দিলে তাদের বউ দাসীর মতো কাম করায়। এহন নিজেই যা পারি হেইডাই খাই।’

আরেক যৌনকর্মী সাজেদার গল্পটা আরো নির্মম। নারায়ণগঞ্জের কাঠপট্টি এলাকায় একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকতো সে। চার বছর আগে সরকার সেখান থেকে উচ্ছেদ করে। এরপর জায়গা হয়েছে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায়। তিন সন্তানের জননী সে। এখন থাকার মতো জায়গা নেই। লকডাউন ও রোজার কারণে খদ্দেরের অভাবে কয়েকদিন ধরে আয় বন্ধ। কখনোবা খদ্দের এলে পুলিশ লাঠি পেটা করে। মাস্তানরা হয়রানি করে। লাঠি দিয়েও পেটায়। রাস্তায় দাঁড়ালে পুলিশ এসে পিটিয়ে থানায় নিয়ে যায়।

দুজনই বললেন, ‘এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি। কিছু চালডাল সাহায্যের ব্যবস্থা খুবই দরকার। আর ভাড়াও দেবার পারছি না। তবে ঘর নেই এমন মেয়েও কিন্তু কম নয়।’

আরেক যৌনকর্মী মধু, বয়স ৫০ এর কোটায়। নারায়ণগঞ্জের রেলস্টেশনে দেখে কথা বলতে এগিয়ে আসে। তিনি বলেন, রাতে বের হলেই র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যান। নাহলে পেটাতে থাকে। ঊরু আর পায়ে লাঠির বাড়িতে ব্যথা হয় আছে, গালে কয়েকটা চড়। সঙ্গে থাকা টাকা নিয়েও যায়। করোনাভাইরাসের কারণে রাস্তায় নামা নিষেধ। নারায়ণগঞ্জের এক নম্বর স্টেশনের ভাসমান এমন অনেক যৌনকর্মীর জীবনের গল্প আলাদা হলেও তাদের কাজ আর কষ্ট একই। কথা হয় মেরি, মধু, নাজমা, সাজেদা, নদী, আসমা, রেবেকাসহ অনেকের সঙ্গে। তারা প্রত্যেকে ভাসমান যৌনকর্মী। করোনাভাইরাস সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ কাজ হারিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তাদের মধ্যে এই যৌনকর্মীরা অন্যতম। এখানকার মেয়েরা জানালেন, পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। প্রতিদিন খাবারের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। তবে (যৌনকর্মী) বইলা কেউ কাজ করতে চাইলেও দেয় না। এমনি সাহায্য করে না কেউ। আমারা বাঁচুম কেমনে কনতো? বলেই কান্নায় চোখটা ভারী হয়ে যায়।

তারা জানান, গত বছর যখন করোনাভাইরাস শুরু হয় তখন সরকারি বেসরকারি সহায়তা পাওয়া গেছে বেশ। তবে এবার চিত্র ভিন্ন। এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা আসেনি। ফলে ঘরভাড়া, পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

নারায়ণগঞ্জের যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের সভাপতি কাজল আক্তার বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, তিনি জাতীয় পর্যায়ে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা ২৯টি সংগঠনের জোট ‘সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কস বাংলাদেশে’র (এসডব্লিউএন) সাবেক সভাপতি। বর্তমানে ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন।

তিনি বলেন, শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরে ৭শ’ যৌনকর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ৩টি স্তরে হোটেল, বাসাবাড়ি ও ভাসমান হিসাবে কাজ করেন। এদের মধ্যে ভাসমান রয়েছেন প্রায় ৩শ’ জন। এসব নারীদের স্থায়ী পরিবারের ঠিকানা নেই। এমনকি আইনি বৈবাহিক সম্পর্কও নেই তাদের।

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা কাজল আক্তার বলেন, আমি ডিসি অফিস থেকে এবার কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। তবে এতো মেয়েদের জন্য সেটা যথেষ্ট না। এখন নিজেদের অর্থ থেকেই যতটুকু পারছি তাদের জন্য করছি। সবাই শুধু ঘৃণা করে দূরেই ঠেলে দেয়। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এই স্বামী সন্তানের ভরণপোষণ তাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে। আয় না থাকলে স্বামীর নির্যাতন তাদের নিত্য সঙ্গী। করোনা পরিস্থিতিতে হোটেল ও বাসাবাড়িতে এ পেশা বন্ধ। ফলে স্বামীর হাতে নির্যাতনের খবর নিয়মিত আসছে বলেও জানালেন কাজল।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে অক্ষয় নারী সংঘের কার্যালয়। রোববার সকালে সেখানে দেখা যায়, ১০/১৫ জন ভাসমান যৌনকর্মী জটলা করছেন। তারা কাজল আক্তারের কাছে এসেছেন সহযোগিতা চাইতে। তিনি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, গত বছর যখন মহামারী শুরু হয় তখন অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি। এবার একেবারেই ব্যতিক্রম। দপ্তরে দপ্তরে চিঠি পাঠালেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ডিসি সাহেব কিছু সহযোগিতা দিয়েছেন কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মেয়েদের অবস্থা খুবই খারাপ।

কাজল আক্তার আরো বলেন, প্রত্যেকের পরিবারে একাধিক সদস্য। বেশিরভাগের স্বামী নেই, আর যাদের আছে তারা সবাই প্রায় নেশা করে। নেশার টাকাও নেয় স্ত্রীর কাছ থেকে। টাকা না পেলে মারধর করে। প্রতিদিন এমন অনেক ফোন আসে, কান্নাকাটি করে।

তিনি বলেন, বয়স হয়েছে এমন যৌনকর্মীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের কাজ নেই, আর তাদের কাছেও এখন খদ্দের যায় না। শারীরিকভাবেও অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর টাকাও নেই। এমন অসহায় জীবনযাপন করছে সেটা সত্যি কষ্টের।

নরসিংদীর আসমা বেগম, ১৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে থাকেন। তার বয়স ৫৫ বছর। খদ্দের পান না বলে ভিক্ষা করে কোনো রকমে জীবন চালান। বাড়িতে বৃদ্ধ মা রয়েছেন। এক মেয়ে তার বিয়ে হয়েছে। সেখানেও টাকা পাঠাতে হয়। করোনায় যার কাছেই হাত পাততে যাচ্ছেন সেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। ফলে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার।

আসমা বলেন, ‘আমাগোর জীবন ঝরা পাতা। শুকনা মরুভূমির মতো। স্টেশনে জন্মাই স্টেশনেই মরি। আমাদের সাহায্য করে কেউ অপবিত্র হতে চায় না।’

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা এনজিও লাইট হাউজের মাঠকর্মী পারভীন সুলতানা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ইনকাম নেই মানে যৌনকর্মী মেয়েদের অবস্থা খুব খারাপ। প্রত্যেকের ৩/৪টি করে সন্তান। এই সন্তানগুলো ঠিকমতো খেতে পায় না। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যাটা কত বড়? জানতে বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও এনজিও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সেড) এর তথ্যমতে, দেশে যৌনকর্মীর মোট সংখ্যা অন্তত ১ লাখ হবে। তবে সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যে অনুযায়ী সারাদেশে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা এক লাখের অনেক বেশি। আর এনজিও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সেড) জরিপ করে বলেছিলো, ১১টি যৌনপল্লীতে প্রায় ৪ হাজার মেয়ে কাজ করেন। এর মধ্যে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের হিসাবে, শুধু ঢাকায় ৭/৮ হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন।

দুর্জয় নারী সংঘের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লাইট হাউজের মাঠ সংগঠক রাজিয়া সুলতানা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, যৌনকর্মীদের জন্য আমাদের দেশে কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। আগেরবার করোনার শুরুতে ব্র্যাক ও কিছু সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায় ৫শ’ যৌনকর্মীর খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সত্যি বলতে মেয়েদের অবস্থা খুব খারাপ। একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা সাহায্য করেছিলাম। এবার যদি পাই তাহলে হয়তো এবারো অনেক মেয়েকে সাহায্য করতে পারবো।

পিছিয়ে পড়া ও অধিকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠী উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা অধিদপ্তর। ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রকনুল হক বলেন, যৌনকর্মীদের নিয়ে অনেক এনজিও কাজ করে। আমরা তাদের সহযোগিতা দিই। এর বাইরে আমাদের নিজস্ব কোনো প্রকল্প এই মুহূর্তে নেই।

এবিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে ভাসমান তিনশ নারীকে চাল, ডালসহ প্রায় ১৭ কেজি ওজনের প্যাকেট দেয়া হয়েছে। এটা বেশ কিছুদিন চলে যাবে।

নারায়ণগঞ্জ প্রায় ৭শ’ যৌনকর্মীর বেশির ভাগই উপোষ দিন কাটাচ্ছে- এদের জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে ডিসি বলেন, আমরা আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে সবটুকু সাহায্য করেছি। এতো মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। তবে করতে চাইলে কয়েকজনকে গার্মেন্টসে সুযোগ করে দিতে পারি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত