ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির দুর্ধর্ষ কাহিনি

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২১, ১৩:৪২  
আপডেট :
 ২১ জুন ২০২১, ১৫:০৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির দুর্ধর্ষ কাহিনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ১ বিলিয়ন ডলার ২০১৬ সালে চুরির পরিকল্পনা করে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা। যদিও তারা মাত্র ৮১ মিলিয়ন ডলার সরাতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এবং বিচ্ছিন্ন দেশটি কীভাবে এলিট সাইবার ক্রিমিনাল টিম তৈরি করল সেটিই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি কীভাবে হয়েছিল, এ নিয়ে তদন্তে নানা বিষয় উঠে আসে। এই হ্যাকারদের পরিচয় এবং কোথা থেকে তারা এসেছিল তা বিস্তারিত বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে জানা যায়।

ঘটনার শুরু একটা প্রিন্টারের ত্রুটি থেকে। সেই সময় এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে তেমন কিছুই মনে হয়নি। বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন তারা।

কিন্তু এটি সাধারণ কোনো প্রিন্টার ছিল না। যে প্রতিষ্ঠানের প্রিন্টার এটি, সেটিও সাধারণ কোনো ব্যাংক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক হলো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ ব্যাংকের কাঁধে এমন একটি দেশের মূল্যবান মুদ্রার মজুদ তদারকির দায়িত্ব, যেখানে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের বাস।

সেখানে রিজার্ভ চুরিতে একটি প্রিন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ১০ তলার অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গায় ছিল। কোটি কোটি ডলারের ট্রান্সফার ব্যাংকের বাইরে ও ভেতরে প্রবাহিত হওয়ার রেকর্ড ছাপানো হতো এটি দিয়ে।

যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে দেখলেন প্রিন্টার কাজ করছে না, তখন তারা ভেবেছিলেন এটি সাধারণ ঘটনা।

প্রিন্টারের সমস্যার বিষয়ে ডেপুটি ম্যানেজার জুবায়ের বিন হুদা পুলিশকে বলেছিলেন— অন্যান্য দিনের মতো এদিনও প্রিন্টার সমস্যা করছে, আমরা এমনটি ধারণা করেছিলাম। কারণ প্রিন্টারে সমস্যা আগেও হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছে, এটি ছিল তার প্রথম ইঙ্গিত। এর পর হ্যাকাররা ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় এবং সাইবার হামলা চালাতে থাকে। তাদের লক্ষ্য ছিল— ১ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া।

অর্থ সরানোর জন্য তারা ফেক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্যাসিনো, দাতব্য সংস্থা এবং বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে।

তদন্তকারীদের তদন্তে ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো কেবল একদিকে নির্দেশ করেছে, তা হলো— উত্তর কোরিয়া সরকার।

সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে উত্তর কোরিয়া প্রধান সন্দেহভাজন হয়ে উঠবে এটি অবাক করার মতো ঘটনা। দেশটি অত্যন্ত দরিদ্র এবং একপ্রকার প্রযুক্তি, অর্থনীতি বলতে গেল সব ক্ষেত্রেই বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন।

ব্যাংকের কর্মীরা প্রিন্টারটি পুনরায় চালু করার পর বুঝতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড় করতে নির্দেশনা গেছে। এর পর দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কিন্তু সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

হ্যাকাররা ঘটনা ঘটায় মূলত বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়। সেই সময় ছিল নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার সকাল। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তখন সব কার্যক্রম চলছে। অন্যদিকে শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবার যখন বাংলাদেশে চুরিটি উদ্ঘাটন শুরু হয়, এর মধ্যে আবার নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে যায়।

এখানে হ্যাকাররা আরও একটি চাল চালে। তারা অর্থ স্থানান্তরের জন্য ফিলিপাইনের ম্যানিলাকে বেছে নেয়। কারণ ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল লুনার ইয়ারের প্রথম দিন। এশিয়ায় ছুটির দিন। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের ছুটি ও সময়ের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে হ্যাকাররা সময় পায় পাঁচ দিন।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের মতে, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা পরিকল্পিতভাবে বহু বছর ধরে এগিয়েছে। দলবদ্ধভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সারা বিশ্বের নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভেঙে অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা তাদের। সাইবার সুরক্ষা ইন্ডাস্ট্রিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা লাজারাস গ্রুপ নামে পরিচিত।

এফবিআই এক সন্দেহভাজন ব্যক্তির প্রতিকৃতি আঁকিয়েছে। যার নাম পার্ক জিন হিয়ক। যিনি পাক জিন-হেক ও পার্ক কোয়াং-জিন নামেও কাজ করেন।

এফবিআইয়ের চোখে সন্দেহভাজন কে এই পার্ক জিন হিয়ক?

নিজেকে একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে তুলে ধরেন পার্ক জিন হিয়ক। উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি থেকে স্নাতক করেছেন তিনি। চীনা বন্দর শহর দালিয়ানে উত্তর কোরিয়ার একটি সংস্থা চোসুন এক্সপোতে কাজ করতেন। এ সংস্থা সারা বিশ্বে তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য অনলাইন গেমিং ও জুয়ার প্রোগ্রাম তৈরি করে। দালিয়ানে থাকার সময়ই একটি ই-মেইল অ্যাড্রেস তৈরি করে জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেছিলেন তিনি। যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা শুরু করেন। এফবিআই জানায়, পার্ক জিন হিয়ক হলেন দিনের আলোয় প্রোগ্রামার আর রাতের অন্ধকারে দুর্ধর্ষ হ্যাকার।

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে নানা ধরনের হ্যাকিং কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তিনি। ধরা পড়লে তাঁর অন্তত ২০ বছরের কারাদণ্ড হবে। তবে পার্ক কিন্তু রাতারাতি একজন হ্যাকার হয়ে ওঠেননি। তিনি উত্তর কোরিয়ার হাজার হাজার তরুণের মধ্যে একজন, যাঁকে শৈশব থেকেই সাইবারযোদ্ধা বানানোর জন্য প্রস্তুতি চলছে। প্রতিভাধর গণিতবিদেরা ১২ বছর বয়সে স্কুল থেকে তাঁকে নিয়ে এসে রাজধানীতে পাঠান। সেখানে তাঁকে সকাল থেকে রাত অবধি নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ জার্নালে/এমএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত