ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

সর্বত্রই ক্ষোভ-প্রতিবাদ

চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ ধ্বংস করে হাসপাতাল নয়

  মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২১, ১৪:৫৭  
আপডেট :
 ১৬ জুলাই ২০২১, ১৯:০৫

চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ ধ্বংস করে হাসপাতাল নয়
ছবি- প্রতিনিধি

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি ভবনকে ঘিরে রয়েছে শতবর্ষী গাছগাছালি আর ছোট-বড় পাহাড়-টিলা। প্রাকৃতিক এই পরিবেশকে নগরবাসী চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ বলে থাকেন। কিন্তু এখানে বড়সড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে সেই ‘ফুসফুস ধ্বংসের উদ্যোগ’ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শতাব্দি প্রাচীন সুউচ্চ বৃক্ষরাজি ঘেরা এলাকায় ৫শ’ শয্যার হাসপাতাল ও ১শ’ আসনের কলেজের মতো একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগে চট্টগ্রামে সর্বমহলে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের দাবি, সেখানে হাসপাতাল হলে বৃক্ষরাজি আর সবুজ বন ধ্বংস হয়ে যাবে। পৌনে এক কোটি মানুষের এই নগরীতে নান্দনিক উম্মুক্ত সবুজ চত্বর বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কালের সাক্ষী অবিভক্ত ভারতের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি হয় ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এই এলাকাটি হরেক প্রজাতির পাখ-পাখালি ও প্রাণির আবাস।

শিরীষ তলা, সাত রাস্তার মাথাসহ পুরো এলাকা জনসমাগমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পহেলা বৈশাখসহ নানা অনুষ্ঠানমালা ছাড়াও ছায়া-সুনিবিড় এ এলাকায় নগরীর প্রবীণরা সকাল-বিকেল ভ্রমণ, ব্যায়াম চর্চা করে থাকেন। শিশু-কিশোর-যুবকদের খেলাধুলা, বিনোদন তথা মানসিক বিকাশের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত সিআরবি।

ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসাবে ১৮৭২ সালে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সিআরবি ভবনের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে ১৮৯৯ সালে ব্যবহৃত প্রথম স্টিম ইঞ্জিন। এসব স্থাপনা দেখতে সেখানে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় জমে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাসপাতাল, কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের মতো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। আর সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের বিরোধিতা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন নগরের ১৭ বিশিষ্টজন।

বিবৃতিতে তারা বলেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরের মাধ্যমে জানতে পারলাম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সিআরবি-সাত রাস্তার মোড় এলাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে বহুতল হাসপাতাল নির্মাণের চুক্তি সম্পাদন করেছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। খবরটি চট্টগ্রামের আপামর মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে। এর কারণ বহুবিধ।

‘হাসপাতালে স্বভাবতই অসুস্থ মানুষদের সমাগম ঘটবে, যা এলাকার পরিবেশকে প্রভাবিত করবে এবং এতে সাধারণের স্বাস্থ্য, প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আমাদের দেশে একজন রোগীকে ঘিরে হাসপাতালে বহুজনের আগমন স্বাভাবিক ঘটনা। এতে এলাকার নির্জনতা তথা স্বাভাবিক পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হবে।’

১৭ বিশিষ্টজনের বিবৃতিতে বলা হয়, দেশে হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশন/ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত দক্ষতার অভাব রয়েছে। এখানেও তার পুনরাবৃত্তিরই আশঙ্কা রয়েছে। কেননা শত প্রতিশ্রুতি ও আইনি ব্যবস্থা সত্ত্বেও এমন নজিরই দেখা যায়। এতে পুরো এলাকা ও আশেপাশের অন্তত অর্ধশত খাদ্য বিপণি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।

বিশিষ্টজনরা বলেন, এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা দরকার। সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগারপাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত যে এলাকাটি রয়েছে তা চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য হয়। সমুদ্রবর্তী নদীবেষ্টিত এই পাহাড়ি নগর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে যুগ যুগ ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও আগন্তুকদের মনযোগ ও প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে। এই আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র আলোচ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ এলাকাটি।

‘শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, এটি ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ওই এলাকায় ১৯৩০ সনের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল, তদুপরি সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি। এটি স্থাপত্যকলা ও ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব বিবেচনা থেকেই এলাকাটিকে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে।’

বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, এখানে বলা প্রয়োজন, আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নই, কেবল একটি প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত বলে মনে করছি। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে অবকাঠামোগতভাবে দ্রুত বর্ধিষ্ণু এই নগরে রাজধানী ঢাকার মতো রমনা পার্ক নেই, নেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মতো সবুজঘেরা কোনো বড় অঞ্চল। নগরের মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র এই একটি এলাকা।

‘তাই সবদিক বিবেচনা করে অবিলম্বে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের সরে আসার অনুরোধ জানাব আমরা। অন্যথায় নাগরিক সমাজ আরও বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে’- যোগ করেন তারা।

বিবৃতিদাতারা হলেন, শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী, অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. সিকান্দার খান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল মনসুর, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস, অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম, ডা. চন্দন দাশ, নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার, অধ্যাপক অলক রায়, স্থপতি জেরিনা হোসেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ও আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান।

এমনকি সিআরবিতে হাসপাতাল চান না খোদ রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরা। ইতোমধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

তাদের বক্তব্য— তারা হাসপাতালের বিপক্ষে নন। তবে এ ধরনের হাসপাতাল করার মতো চট্টগ্রাম নগরে রেলওয়ের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু জমি প্রভাবশালীরা দখল করে আছে। সেগুলো উদ্ধার করে হাসপাতাল করা যায়। সিআরবিকে কেন বেছে নেয়া হলো, তা তাদের বোধগম্য নয়।

যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক) আহসান জাবীর বলেন, চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতালের নকশা তৈরি করে কাছে জমা দিয়েছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। চউক নকশাটির অনুমোদন দিলে প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হবে।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল নির্মিত হলে পরিবেশের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা যাচাই করতে পরামর্শক নিয়োগ করেছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। এরপর পরিবেশ রক্ষায় করণীয় নির্ধারণ করা হবে। তাছাড়া হাসপাতাল নির্মাণ করতে গিয়ে শতবর্ষী গাছগুলো যাতে কাটা না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।

এদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকলেও চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পক্ষে নিজেদের অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিরোধিতাও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

গত বুধবার বাংলাদেশ রেলওয়ে, সিআরবি, চট্টগ্রামের প্রকল্প পরিচালক এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু/পূর্ব) মো. আহসান জাবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ইউনাইটেড এরন্টারপ্রাইজের ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং ১০০ আসনবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য ২০২০ সালের ১৮ মার্চ চুক্তি হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিঃ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে হাসপাতালটি নির্মাণ করবে এবং ৫০ বছর পর সম্পূর্ণ হাসপাতাল রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে যা তখন সম্পূর্ণরুপে রেলওয়ে হাসপাতাল হিসেবে গণ্য হবে। হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য সিআরবি রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালের পার্শ্বে গোয়ালপাড়া এলাকাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বমোট ৬ একর জায়গার ওপর হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে বর্তমানে রেলওয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অতিপুরাতন ও জরাজীর্ণ বাসাবাড়ি বিদ্যমান।

এতে আরও বলা হয়, ওই স্থানে বসবাসরত কর্মচারী/কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। আরও যারা আছেন তাদেরকে পর্যায়ক্রমে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ প্রদান করা হবে। কিন্ত সেখানে শতবর্ষী কোনো গাছ বিদ্যমান নাই। ওই স্থানে বিদ্যমান গাছ এবং ভূমিরুপ এর অবয়ব ঠিক রেখেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সিআরবি শিরীষতলা এলাকা ও সাতরাস্তার মোড়ে শতবর্ষী গাছ বিদ্যমান, কিন্তু ওই স্থানটি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জায়গা নয়। এ কারণে শতবর্ষী গাছগুলো বিনাসের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই গোয়ালপাড়াতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সিআরবি এলাকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিরীষতলায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কোনরুপ প্রতিবন্ধকতা/বিঘ্নতা ঘটবে না।

এতে উল্লেখ করা হয়, এই হাসপাতালে রেলওয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা বিশেষ সুবিধায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামবাসীর চিকিৎসা সেবার মান আরও একধাপ এগিয়ে যাবে ফলে উন্নত চিকিৎসা সেবার জন্য বিদেশ গমণের প্রবণতা হ্রাস পাবে।

অন্যদিকে, পূর্ব রেলের সদর দপ্তর চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল হলে পরিবেশ ও প্রকৃতি নষ্ট হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের গভর্নর আমিনুল হক বাবু।

পরিবেশ নষ্ট করে হাসপাতাল নির্মাণ না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শতবর্ষী বৃক্ষ, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা সিআরবিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণির আবাস রয়েছে। সিআরবির ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ এবং বিনোদনের স্থান। এমন একটি জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, জনসমাগম বৃদ্ধি ও মেডিকেল বর্জ্যের কারণে সিআরবির বর্তমান পরিবেশ ও প্রকৃতি নষ্ট হবে।

মানবাধিকার নেতা আমিনুল হক বাবু আরও বলেন, গাছপালামণ্ডিত সিআরবি এলাকাটিকে চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে গণ্য করা হয়। এর আগে বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া সিআরবিতে রাস্তা সম্প্রসারণের নামে রেলওয়ের শতবর্ষী গাছ কাটা হয়েছে। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা আমরা জানতে পারিনি।

‘সিআরবির পরিবেশ ধ্বংসের ধারাবাহিকতায় এবার সেখানে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অপচেষ্টা চলছে। প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় একটি শতবর্ষী রেইনট্রি ছাড়াও কিছু বড় গাছ আছে। এছাড়া আছে পূর্ব রেলের সদর দপ্তর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আছে স্টাফ কোয়ার্টার। এখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা অযৌক্তিক। হাসপাতাল করতে চাইলে সিআরবির বাইরে রেলের অনেক অব্যবহৃত জমি আছে, সেখানে করা যায়’-যোগ করেন তিনি।

ঐতিহাসিক সিআরবি ও শতবর্ষী বৃক্ষ রক্ষায় হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আমিনুল হক বাবু।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও কর্ণফুলী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, হাসপাতাল করার মতো চট্টগ্রামে অনেক জায়গা থাকার পরও সিআরবিকে কেন বেছে নেয়া হলো তা আমার বোধগম্য নয়। এখানে শতবর্ষী গর্জন ও রেইনট্রিসহ অনেক গাছ আছে। পাখির কোলাহল, বসার জায়গা, হাঁটাহাঁটির পথ, এমনকি ইকোসিস্টেমের অঙ্গ-অংশও এখানে।

‘প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরা এমন গণসামাজিক জায়গায় কংক্রিটের ভারী স্থাপনা নির্মাণ খুবই দুঃখজনক। আর শহরের মাঝখানে কেন হাসপাতাল হবে? যারা এটা করছেন, তাদের সরে আসতে হবে।’ এর বিরুদ্ধে নগরবাসীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরব হওয়ারও আহ্বান জানান ড. ইদ্রিস আলী।

এদিকে সিআরবিতে ছয় একর জায়গাজুড়ে হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণায় আটজনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ)। বুধবার (১৪ জুলাই) বিএইচআরএফ পরিচালক, ট্রাস্টি ও চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট এএম জিয়া হাবিব আহসানের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই নোটিশ পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম।

নোটিশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে বিবাদী করা হয়।

সাতদিনের মধ্যে 'পরিবেশ বিনষ্টকারী' এই প্রকল্পের স্থান অন্য কোনো যৌক্তিক জায়গায় সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যাতে পরিবেশ, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হানি না হয়। প্রকল্পের স্থান পরিবর্তনে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে বিএইচআরএফ’র পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপযুক্ত আদালতে মামলা কিংবা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করার ঘোষণাও দেয়া হয় নোটিশে।

এএম জিয়া হাবিব আহসান জানান, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার পূর্বাঞ্চলের কার্যক্রম সম্পাদন ও নিয়ন্ত্রণ করে, যা ভৌগলিকভাবে চট্টগ্রাম শহরের একটি পাহাড়ি এলাকা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কর্তৃক যে সকল এলাকা ও স্থাপনাকে ঐতিহাসিক, স্থাপত্য ও পরিবেশগত সংরক্ষিত এলাকা বা স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) তার মধ্যে অন্যতম। উক্ত তালিকা সিডিএ’র ওয়েভ সাইটে সংরক্ষিত আছে। সুতরাং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকাটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, স্থাপত্য ও পরিবেশের স্বার্থে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, যে গাছ, পাহাড়-টিলা কেটে হাসপাতাল করা হচ্ছে, সে রকম গাছগাছালি কি আমরা লাগাতে পারছি? সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। এটি শত বছরে গড়ে উঠেছে। অথচ রাতারাতি এই পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সিআরবি একটি ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে চট্টগ্রামের বাইরে থেকেও লোকজন আসে। এসব বিবেচনায় এখানে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিতান্তই অবিবেচক।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত