ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

বন উজাড়, রাজত্ব কার ?

  এম এ কাইয়ুম, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৪৩  
আপডেট :
 ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:০১

বন উজাড়, রাজত্ব কার ?
ছবি: প্রতিনিধি।

কুলাউড়ায় সৃজিত সামাজিক বনায়ন নিয়ে বাঙ্গালী ও উপজাতি খাসিয়া সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে। বিষয়টি খুবি গুরুত্বসহকারে দেখছে প্রশাসন।

বন বিভাগ ও উপকারভোগী এবং খাসিয়াদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও মানববন্ধনে সরগরম পাহাড় থেকে শহর অবধি। এমন পরিস্থিতি রীতিমতো বিব্রত প্রশাসন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একপক্ষ এগিয়ে আসলে আরেক পক্ষ যুক্তিতর্কে উসকে দিতো। বিষয়টি নিয়ে মৌলভীবাজার জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তারা বৈঠকে বসছেন মঙ্গলবার।

দ্বন্দ্ব ভুলে জটিলতা নিরসনে উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তার সম্প্রীতির ডাকে সাড়া দিয়েছে উভয় পক্ষ। আসতে পারে একটি স্থায়ী সমাধানের সিদ্ধান্ত।

বেশ গুরুত্বসহকারে আজকের সভা হবে উপজেলার কর্মধায়। সভাকে কেন্দ্র করে কঠোর সতর্ক অবস্থানে উপজেলা প্রশাসন। সভায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সোমবার রাতে সভাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা প্রশাসন। মূলত সামাজিক বনায়ন নিয়ে উপকারভোগী কর্মধার বাসিন্দা রফিক মিয়ার নেতৃত্বে বশির মিয়া, হারিছ আলী, হারুন মিয়া, ইসরাইল আলী গংদের সাথে খাসিয়াদের সম্প্রতি বিরোধের সূত্রপাত ঘটে পাহাড়ের ছোট কালাইগিরি নামক স্থানের ৬৫ ও ১০৫ দাগের সরকারি বনভূমির পতিত ১০ হেক্টর জায়গা নিয়ে। খবর নিয়ে দেখা যায়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে খাসিয়ারা পান চাষের নামে নির্বিচারে উজাড় করছে বন। এ সংরক্ষিত বন রক্ষা করতে একাধিক বার হামলার শিকার হতে হয়েছে বন বিভাগের কর্মীদের।

সৃজিত বনায়নের একেকজন উপকারভোগীর উপর ৫-৭টি করে মামলা করেছে খাসিয়ারা। শুধু মামলা নয় একাধিক হামলার শিকার হয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।

খাসিয়াদের চতুরতায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। খাসিয়ারা ২০০৬ সালে যে পরিমান জায়গা চাষাবাদ করত বর্তমানে এরচেয়ে দেড়গুণ বেশি জায়গা জুম চাষাবাদ করছে।

বন উজাড়ের চরম উদাসীন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। অদৃশ্য কারণে তারা নির্বিকার।

কর্মধা ইউনিয়নের নলডরী বনবিট সূত্র জানায়, নলডরী বিটের অধীনে ৪টি মৌজায় প্রায় ২৪৬৮.৫৪ একর সংরক্ষিত বনভূমি ছিল। এরমধ্যে বিভিন্ন সময়ে খাসিয়ারা ১৯৩৭.১২ একর জায়গা দখল করে নিয়েছে।

এই জায়গা দখল করে পান চাষে নামে গাছের ডালপাল উজাড় করে বিরানভূমিতে পরিণত করেছে। অবশিষ্ট ৫৩১.৪২ একর জায়গা দখলে নিতে চায় তারা।

মুড়ইছড়া বন বিটের রোশনাবাদ মৌজার রোশনাবাদ মৌজার মোট ৩৪৬০ একর সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে ২ হাজার একর খাসিয়াদের জবর দখলে। বাকি বাঁশ মহাল ও প্রকৃতি বনায়নের অংশের থাকা ১৪৬০ একর জায়গা দখল করতে চায় খাসিয়ারা।

অনুসদ্ধানে দেখা যায়, মুড়ইছড়া বিটের রোশনাবাদ মৌজার ১০৫ নং দাগে মোট ৫৮৬ একর পতিত ভূমি রয়েছে। তারমধ্যে ১৯৭৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী একটি গেজেট প্রকাশিত হয়।

ওই গেজেট বন বিভাগের বন আইনের ৪নং ধারা অনুযায়ী ১০৫ নং দাগের মোট পতিত জায়গার ২৮৬ একর বন বিভাগের নামে। একই দাগের মোট ১৪৬. ৫ একর পতিত জায়গা সরকার থেকে লিজপ্রাপ্তহন পুঞ্জির হেডম্যান রোজবেল খাসিয়া।

লিজ পাওয়ার পর সরকারি নিয়ম নীতি অনুসরণ না করায় ১৯৮৮ সালে পুঞ্জির হেডম্যান রোজবেল খাসিয়ার লিজকৃত জায়গা সরকার বাহাদুরের নামে এস.এ রেকর্ডভুক্ত হয়। এতেই টনক নড়ে রোজবেল খাসিয়ার।

এনিয়ে রোজবেল খাসিয়া মৌলভীবাজার সাব-জজ প্রথম আদালতে স্বত্ত মামলা দায়ের করেন। এতে সরকারের পক্ষে রায় ও ডিক্রি হয়। রোজবেল খাসিয়া এই রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে জেলা সাব জজ আদালতে স্বত্ত আপিল মামলা দায়ের করলে ২০১৮ সালে পরবর্তীতে রায় ও ডিক্রি রোজবেল খাসিয়ার পক্ষেই আসে। এ রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে বন বিভাগ ২০১৯ সালে আপিল করে।

ঘটনাক্রমে পাহাড় রক্ষার স্বার্থে ১৯৯৭ সালে কর্মধা ইউনিয়নের তৎক্ষালীন ইউপি চেয়ারম্যান নজিব আলীর মধ্যস্থতায় খাসিয়াদের হেডম্যানদের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি (স্থানীয়) সম্পাদন হয়।

চুক্তির মুল উদ্দেশ্য ছিলো খাসিয়ারা পাহাড়ের ভেতরে প্রবহমান ফানাই নদী অতিক্রম করতে পারবেনা। এবং লিজপ্রাপ্ত ১৪৬ একর জায়গার বাইরে যেতে পারবেনা বা ভোগ দখলে নেবেনা।

কিন্তু বর্তমান ম্যাপে দেখা যায়, স্থানীয় চুক্তির লঙ্ঘন করে খাসিয়ারা ফানাই নদী অতিক্রম করে ৬/৭ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পাহাড়ের পতিত জায়গা জবর দখল করে ডলুছড়া পান পুঞ্জি গড়ে তুলেছে।

এ ঘটনায় কুলাউড়া থানায় একটি মামলাও হয়। বর্তমানে আরও ৫ কিলোমিটার ভেতরে সামাজিক বনায়নে বাধাগ্রস্ত করছে খাসিয়ারা। ২০০৬ সালে যে পরিমান জায়গায় জুম চাষাবাদ করত বর্তমানে এর চেয়ে দেড়গুণ অধিক জায়গায় জুম চাষাবাদ করছে খাসিয়ার।

এদিকে বন বিভাগ সমাজিক বনায়নের কিছু বিধি লঙ্ঘন করে বনায়নের কাজ শুরু করে। সম্প্রতি এই সুযোগ কাজে লাগায় খাসিয়ারা। সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্যে রুপণকৃত প্রায় ২৫ হাজার চারা ডলুছড়া পান পুঞ্জির হেড ম্যান লবিংসুমের নেতৃত্বে উপড়ে ফেলে খাসিয়ারা।

এতে বনায়নের ৭ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়। এনিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠ সামাজিক বনায়নের সদস্যরা। এঘটনায় ১০ আগষ্ট কুলাউড়া থানায় লিখিত অভিযোগ দেয় বনবিভাগ।

২৪ আগষ্ট দিবাগত রাতে সামাজিক বনায়নের সদস্যরা খাসিয়াদের বেলুয়া পুঞ্জিতে হানা দেয় বলে দাবি করে খাসিয়ারা। এসময় প্রায় ২৮০০ পান গাছ কাটা হয়। এ ঘটনায় ২৫ আগষ্ট ৮ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৩৫-৪০ জন অজ্ঞাত রেখে বেলুয়া পুঞ্জির হেডম্যান হেনরী তালাং থানায় অভিযোগ করেন।

পান গাছ কাটার পর খাসিয়া-বাঙ্গালির বিরোধ আবারও প্রকাশ্যে আসে। সামাজিক বনায়নের সদস্য ও বনবিভাগকে বনায়নে যেতে তীব্র আপত্তি জানায় খাসিয়ারা।

পান গাছ কাটার বদলা নিতে বেলু ও ডলুছড়া পান পুঞ্জির খাসিয়ারা একত্রিত হয়ে ২৭ আগষ্ট ছোট কালাইগিরির বনায়নের উপকারভোগি পাহারাদার স্থানীয় টাট্টিউলী গ্রামের বাসিন্দা ছুরক মিয়া ও আছকির আলীর উপর হামলা করে।

এসময় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের সৃজিত বনায়নের ২ শতাধিক গাছ কাটে এবং সেখানে বন বিভাগের একটি ক্যাম্প ভাঙচুর করে খাসিয়ারা। এমনটাই দাবি করেন উপকারভোগীরা।

এ খবরে সমতলে ছড়িয়ে পড়লে মুরইছড়া বাগানের রাস্তা সম্মুখে উপকারভোগিরা জড়ো হয়। সেখানে বাঙ্গালীরা প্রকাশ্যে হামলা চালায় খাসিয়া ও গারো সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের উপর।

ওই ঘটনায় বাঙ্গালিদের হামলায় আহত হন বেলকুমা পুঞ্জির লিভিংস্টোন ইয়ং নিয়ং, লেবেলসন খংজ, ফিডালিয়া লামিন, কুকিজুরী পুঞ্জির বাসিন্দা সিল পংলং ও রেডিমার চেল্লা।

একই দিনে কুকিজুরী পুঞ্জির রাজ নংরুম ও মুরইছড়া পুঞ্জির গারো তরুণ উজ্জ্বল এম সাংমাকে ওই স্থানে বেধড়ক মারধর করে বনায়নের উপকারভোগী বাঙ্গালিরা। এ নিয়ে খাসি এবং সামাজিক বনায়নের উপকারভোগিদের পক্ষে কুলাউড়া থানায় পৃথক দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

গত ২৮ আগস্ট শনিবার সামাজিক বনায়নের সদস্যরা মুড়ইছড়া বাগানের সম্মুখে একত্রিত হয়ে পান বহনে আপত্তি করে দিন মজুর বাঙ্গালিদের। এসময় বেশ কয়েকটি পানের খাঁচা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী, এডিশনাল এসপি (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাওছার দস্তগীর ও কুলাউড়া থানার ওসি বিনয় ভূষন রায়। প্রশাসনের পরিদর্শের পর দিন ২৯ আগষ্ট সামজিক বনায়নের উপকারভোগীদের পাহাড়ে যেতে খাসিয়ারা বাঁধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বন বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে জবরদখল করে খাসিয়ার স্থাপন করেছে কয়েকটি পান পুঞ্জি। একেকটি পান পুঞ্জিতে ৩০/৩৫ পরিবার আবার কোনো কোনো পুঞ্জিতে ৫০/৬০টি পরিবার গৃহনির্মাণ করে জীবনযাপন করছেন।

তাদেরকে কোন সরকারি খাজনা, ট্যাক্স কিছুই দিতে হচ্ছে না। যেনো তাদের নিয়মেই চলে পুঞ্জির সবকিছু। বনের রাজত্বে খাসিয়াদের কাছে কোনঠাসা বন বিভাগ।

একেক খাসিয়া শত শত একর জায়গায় পান চাষ করে পান বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা মাসিক উপার্জন করছে। তবে দেশের কোনো ব্যাংকে তারা টাকা সঞ্চয় করে না। পান বিক্রি বাবত উপার্জিত লাখ লাখ টাকার হদিস নেই দেশে।

পান চাষের খাসিয়ারা নষ্ট করছে বনের সৌন্দর্য্য। এক সময় পাহাড়ে বেশ কয়েকটি বাঁশ মহাল ছিল। বাঁশ মহাল ইজারা দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেতো।

কিন্তু বাঁশ মহালে পান না হওয়ায় সেই বাঁশ মহালগুলো কেটে খাসিয়ারা দখলে নিয়েছে। পান গাছে যাতে ছাঁয়া না ধরে সেজন্য শত বছরের পুরনো গাছের মাথাসহ ডালপালা কেটে ফেলে।

ফলে হারিয়ে গেছে বনাঞ্চলের হরিণ, বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। কিন্তু পাহাড় উজাড় করে পান চাষ ও বসতি স্থাপন এবং বণ্যপ্রাণী শিকার করে খেয়ে ফেলার কারণে বর্তমানে জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে।

এ ঘটনায় বিট অফিসার অর্জুন কান্তি দস্তিদার বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন। বন বিভাগের মামলার পর পান কাটার অভিযোগ এনে স্থানীয় বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে কুলাউড়া থানায় অভিযোগ দেয়।

বন বিট এক কর্মকর্তা বলেন, সংরিক্ষত বনাঞ্চলের পুরোটাই বাঁশ ও গাছপালায় ভরপুর ছিলো। কিন্তু খাসিয়ারা পুরো বনকেই উজাড় করে ফেলেছে।

বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপকার ভোগীরা তাদের বনায়ন দেখাশুনা করবে। সামাজিক বনায়নের বিধিমালায় আছে সাধারণ জনগণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা করবে।

আমাদের নিরাপত্তার জন্য সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু খাসিয়ারা চায় না আমাদের সঙ্গে পাবলিক থাকুক। তাই তারা উপকারভোগী ও সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।

কেউই তাদের পান জুমের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যদি পাবলিকদের মামলা দিয়ে হয়রানি করে তাহলে মামলার ভয়ে পাবলিক আমাদের সঙ্গে থাকবে না। আর আমরা জনবল কম থাকায় তাদের সঙ্গে পারবো না।

বন বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার বলেন, দেশের সম্পদ পাহাড় রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সব সময়ই পাহাড় কাটার প্রতিবাদ করেছি। বিভিন্ন সময় খাসিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তাই আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য খাসিয়ারা চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত