জামাই আদরেই দিন কাটছে সম্রাটের, চিঠি দিয়েও ফেরত পাচ্ছে না কারা কর্তৃপক্ষ
মো.ফরহাদ উজ্জামান
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১৯:২২ আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ২০:০৫
ক্যাসিনোবিরোধী ও শুদ্ধি অভিযানের দুই বছর শেষ হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। সে অভিযানের সবচেয়ে আলোচিত আসামি হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকে কখনো বুকে ব্যথা, আবার কখনো হার্টের সমস্যা- এমনই সব কারণ উল্লেখ করে কারাগার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। অস্ত্র মামলা, অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনোকাণ্ড মামলাসহ কয়েকটি মামলার আসামি সম্রাট।
অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, প্রভাব খাটিয়ে ও অর্থের বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কাটাচ্ছেন আয়েশি জীবন, করা হচ্ছে জামাই আদর। বারবার চিঠি দিয়েও ফেরত পাচ্ছে না কারা কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে করা পাঁচ মামলার মধ্যে অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলা বিচারাধীন। মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অবৈধ সম্পদের মামলাটি তদন্তাধীন। মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচারেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
চিকিৎসার অজুহাতে সম্রাটের মতো আরো অনেক আসামির বিতর্কের মুখে কারাগারে ফিরতে হয়েছে। ফিরলেও আবারো কিছু দিন পরই ফিরছেন পছন্দের ঠিকানা হাসপাতালের প্রিজন সেলে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কিছু কারাবন্দি কারাগারে আছেন, নাকি নিজের বাড়িতে আছেন তা বোঝার উপায় নেই। নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করা, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অফিসের কার্যক্রমে অংশ নেয়া সবই চলছে তাদের।
এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে প্রিজন সেলে বসেই ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিনের জুম মিটিংয়ে অংশ নেয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে বিষয়টি আবারো আলোচনায় আসে। এ কারণে গত ৩ জুলাই কারাগারে ফেরত পাঠানো হয় তাকে। মূলত এ ঘটনার পরই বন্দিদের দীর্ঘ ‘চিকিৎসা’ নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন। নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় কারা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও।
বিতর্কের মুখে রফিকুল আমিনকে ছাড়পত্র দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলেও প্রিজন সেলে আয়েশি অবস্থায় দিন কাটছে আলোচিত কারাবন্দি যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের।
ইতোমধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ সম্রাটকে ফেরত পেতে ২৩ বার চিঠি দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সূত্র বলছে, কারাগার ও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি চক্র মোটা টাকার বিনিময়ে অসুস্থতার অজুহাতে তাদের হাসপাতালে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন। অথচ গ্রেপ্তারের আগে তারা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে চষে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ।
অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসা নিতে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে সামর্থ্যবানদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য বেশি তারা হাসপাতালেই থেকে যাচ্ছেন মাসের পর মাস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর কিছু দিন কারা হাসপাতালে ছিলেন মাদক, অস্ত্র আইন ও অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলার আসামি সম্রাট। মাসখানেকের মধ্যেই ওই বছরের ২৪ নভেম্বর তিনি বুকে ব্যথা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি হন। সে দফায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে টানা ৮ মাস থাকেন। সে সময় ১১ বার চিঠি দিয়েও তাকে ফেরত পায়নি কারা কর্তৃপক্ষ। উল্টো কারাগারের বেডে বসে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সমালোচনার মুখে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে গিয়েও তিনি কারা হাসপাতালেই থাকেন।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর আবারো তিনি একই হাসপাতালে ভর্তি হন। এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই আছেন। ইতোমধ্যে তাকে ফেরত পেতে আবারো ২৩ বার চিঠি দেয়া হলেও কর্ণপাত করছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ জুলাই সম্রাটের হার্টের অবস্থা খারাপ হলে তাকে হাসপাতালের ডি-ব্লকের সিসিইউ ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে ভর্তি রাখা হয়। তবে বর্তমানে তিনি বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেলে বলে জানিয়েছে হাসপাতালের একটি সূত্র।
এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহাবুবুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, কারা হাসপাতালে যতক্ষণ চিকিৎসা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কারাবন্দিকে চিকিৎসার জন্য বাইরের কোনো হাসপাতালে পাঠানো হয় না। যখন বড় ধরনের সমস্যা হয় তখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কারাবন্দিদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রোগী সুস্থ হয়ে গেলে ছাড়পত্র দিয়ে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আমরা প্রতি ১৫ দিন পর আসামিদের ফেরত পাঠানোর তাগাদা দিয়ে চিঠি পাঠাই। সম্রাটের জন্য চিঠি দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন ফেরত পাঠাচ্ছে না, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
জেলার বলেন, রোগী কেমন আছেন, সেটা চিকিৎসক ভালো বুঝবেন। আমাদের দায়িত্ব তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো হলে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন বারবার চিঠি পাঠালেও রেসপন্স করছে না সেটা তারাই জানেন। সম্রাটের শারীরিক অবস্থা কেমন এর কোন জবাব দিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কতোবার চিঠি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে জেলার বলেন, প্রতি মাসে দুই বার করে চিঠি দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় বাংলাদেশ জার্নালের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। পরের দিন শনিবার আবারও যোগাযোগ করা হলে অসুস্থতার কথা বলে সম্রাটের বিষয়ে কথা না বলেই ফোন কেটে দেন।
সম্রাটের মামলায় বিচার কতোদূর
তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার প্রার্দুভাবে ক্যাসিনো মামলাগুলোর তদন্তে ও বিচারে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। করোনা না থাকলে এতদিনে এসব মামলার তদন্ত ও বিচার অনেকটাই গুছিয়ে আনা সম্ভব ছিল।
এদিকে ক্যাসিনোর ১৩ মামলার মধ্যে ১০টির অভিযোগপত্র দিয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এর মধ্যে সম্রাট আর খালেদের তথ্যের জন্য আটকে আছে অভিযোগপত্র।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছে, পাচারকৃত অর্থের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষ হয়নি দুই বছরেও। এ কারণে বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা সম্রাটসহ আরও কয়েকজনের তিন মামলার অভিযোগপত্র দিতে সময় নিচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। সম্রাটের ১৯৫ কোটি টাকা পাঁচারের প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
এ ব্যাপারে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, সম্রাট চৌধুরীর যে মামলাটা এটাতে ১৯৫ কোটি টাকা মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে পাঁচারের তথ্য আমাদের কাছে আছে। এখন আমরা পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়ার পরে যাচাই বাচাই করে বলতে পারব মূলত কত টাকা পাঁচার হয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, এখানে দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। একটি হলো-মামলাগুলো তদন্তে তদন্ত সংস্থার দক্ষতার ঘাটতি থাকতে পারে। অপর দিকে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয় থাকতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার দীর্ঘসূত্রতার নমুনা রয়েছে। সার্বিকভাবে দীর্ঘ সময়ে তদন্ত শেষ করতে না পারায় তদন্ত সংস্থাগুলোর দক্ষতার ঘাটতি প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া তদন্ত সংস্থার সদিচ্ছা ও সৎ সাহসের ব্যাপারও রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ওপর যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেহেতু এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল। দৃষ্টান্তমূলক সুরাহা হলে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা আরও বাড়বে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্রাট, খালেদ মাহমুদসহ অন্যান্য যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়েছে, সেসব মামলার বিচারকাজ চলছে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৫ অক্টোবর গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ওই গ্রামের জামায়াত নেতা মনির চৌধুরীর বাড়ি থেকে সম্রাট ও আরমানকে আটক করা হয়। পরদিন তাদের নিয়ে রাজধানীতে নিজ নিজ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে র্যাব।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমজে