ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

দরিদ্রদের টার্গেট করে শত কোটি টাকা লোপাট

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৮:৪৫

দরিদ্রদের টার্গেট করে শত কোটি টাকা লোপাট
র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. এর প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জন।

প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। বিশেষ করে রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা ও গার্মেন্টেস কর্মীদের টার্গেট করে এসব টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। এসব টাকায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন নিজের নামে রাজধানীতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফ্ল্যাট, জমি, গার্মেন্টস ও ট্যুর ট্রাভেলসসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কাজ করতেন জসিম উদ্দিন। পরে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ২০০৩ সালে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতারণার উদ্দেশ্য গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ এ বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করানো হতো। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বস্তি এলাকার গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। অধিক মুনাফার লোভে করোনার সময়েও ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ে ডিপিএসের টাকা জমা দিলেও লভ্যাংশ পায়নি। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করা হতো। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী, পরে প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গতকাল সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মিরপুরের নান্নু সুপার মাকের্টে এলাকায় অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. এর প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাব বলছে, প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। যা তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফা প্রদানের শর্তে টাকা গ্রহণ করা হতো। সমবায়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসনের দায়িত্বে নিয়োজিত সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন ছিল কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির। ২০১৯-২০ সালে সমবায় অধিদপ্তর অডিটও করে। অডিটে দেখানো হয়, মাত্র ৫১৮ জন সদস্য। লেনদেন মাত্র ৮২ লাখ টাকা। তবে র‌্যাবের দাবি প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। প্রতিষ্ঠানটিতে লেনদেন হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি।

গ্রেপ্তাররা হলেন- মো. চাঁন মিয়া (৩৮), এ কে আজাদ (৩৫), মো. রেজাউল (২২), তাজুল ইসলাম (৩১), শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মাসুম বিল্লা (২৯), টিটু মিয়া (২৮) ও আতিকুর রহমান (২৮)।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, অভিযানের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটি অন্যান্য সদস্যরা পলাতক রয়েছেন। মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন। এমনকি যুগ্ম সম্পাদকও নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। এটি এক রকম পারিবারিক সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত।

সরকারি হিসেবে, প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জনের কথা উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ ও র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। যারা শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছেন।

র‌্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে এক হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয় তবে পাঁচ বছরের ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেয়া হবে। টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছর প্রতিমাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন। আর কোম্পানির কোনো সদস্য যদি নতুন কোনো সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারে তাহলে টার্গেট সংগ্রহকারীকে মাসে এক হাজার টাকা এবং এফডিআরকারী সদস্যকে মাসে দুই হাজার টাকা প্রদানের প্রলোভন দেয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে যা দেশে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।

গ্রেপ্তারদের জিঙ্গাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার শাকিল আহম্মেদ ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’ এ বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বস্তি এলাকার গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। যা তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফা প্রদানের শর্তে টাকা গ্রহণ করা হতো।

এদিকে ভুক্তভোগী তরিকুল ইসলাম রুবেল জানান, আমার স্ত্রী গার্মেন্টেসে চাকরি করত। ২০১৯ সালে তার পাশের এক অপারেটর আমার স্ত্রীকে বলে- তুমি যদি এখানে (কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.) টাকা রাখো তাহলে প্রতিমাসে লাখে ১৮০০ টাকা পাবে। পরে আমার স্ত্রী এখানে দেড় লাখ টাকা রাখে। তাকে আবারও বলা হয়, তুমি ডিপিএস করো আরও লাভ পাবে। আমার স্ত্রী তাদের কথা মতো দুইটি ডিপিএস করে। একটি ২৫০০ ও অপরটি ১২০০ টাকার। এসব টাকার লভ্যাংশ প্রতিমাসে দেয়ার কথা থাকলেও প্রথম দুই তিন মাস দিয়েছিল। কিন্তু পরে আর টাকা দেয়া হয়নি। মূল টাকা ফেরত চাইলেও তারা সেটা দেয়নি, উল্টো ঘুরাতে থাকে। এভাবে দীর্ঘদিন তাদের অফিস ঘুরাঘুরি করছি।

মূল অভিযুক্ত জসিমের বিষয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পলাতক আসামি জসিম উদ্দিন মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কাজ করলেও ২০০৩ সালে তিনি অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস নিবন্ধন লাভ করে, ২০১৩ সালে সমিতিটি পুর্ননিবন্ধন পায়।

মোজাম্মেল হক বলেন, সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালের তাদের মোট সদস্য সংখ্যা ৫৩৭ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০-২৫ হাজার সদস্য গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। জসিম কোম্পানিতে নতুন নতুন সদস্য ভর্তির জন্য পুরাতন সদস্যদের চাপ দিতেন।

অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক আরও বলেন, জসিমের আয়ের মূল উৎস কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে ভুক্তভোগীদের ডিপিএস বা এফডিআরের টাকা। অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির জসিম সমিতির অফিসে আসতেন না। সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করতেন। গ্রাহকের টাকায় তিনি বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট, গ্রিন রোডে ফ্ল্যাট, গাজীপুরের মাওনায় রয়েছে আরও দুটি প্লট ও তিন তলা ফ্ল্যাট, মিরপুরে বাড়ি, কাউনিয়া মৌজা ও গাজীপুরে বেশ কয়েক একর জমি ক্রয় করেছেন।

তিনি আরও বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল আহম্মেদের নিজ জেলা নরসিংদী। তিনি টঙ্গী কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ২০১৫ সালে তিনি কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। শাকিলের যোগদানের পর থেকে গ্রাহকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তিনি গ্রাহকদেরকে লোভনীয় অফার দিয়ে সমিতিতে ডিপিএস/এফডিআর এ টাকা রাখতে প্রলুব্ধ করত।

এদিকে জসিমের অবস্থান জানতে চাইলে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, জসিম একটি ইনভিজিব্যুল চরিত্র। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে, খুব দ্রুতই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এফজেড/ওয়াইএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত