ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

মুরাদের ‘মুকুল বাহিনী’ সরিষাবাড়ীর ত্রাস

  শওকত জামান, জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:২৭  
আপডেট :
 ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৩৯

মুরাদের ‘মুকুল বাহিনী’ সরিষাবাড়ীর ত্রাস
মুরাদ হাসান (ডানে), মুকুল (বামে)

জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে পদত্যাগী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান স্থানীয় নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে গড়ে তুলেছিল মুকুল বাহিনী। ক্ষমতার দাপটে দাপিয়ে বেড়ানো মুকুল বাহিনীর ক্যাডাররা পরিণত হয় মূর্তিমান আতঙ্কে। কায়েম করে সন্ত্রাসের রাম রাজত্ব। তাদের অপকর্মে কেউ টু শব্দটি করলে নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার।

মুকুল বাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। লাঞ্চিত হয়েছেন সিনিয়র নেতারা। এদের ভয়ে সাধারণ মানুষের দিন কাটতো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে। তাদের দাপটে ভয়ে থাকতো সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

মুরাদের পদত্যাগের খবরে জনরোষ থেকে নিজেদের বাঁচাতে মুকুল বাহিনীর ক্যাডাররা সরিষাবাড়ী ছেড়ে পালিয়েছে। মুকুল বাহিনীর তাণ্ডবে সরিষাবাড়ি আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছিল। বাহিনীর প্রধান মুরাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড সাখাওয়াত আলম মুকুল। এই মুকুল ‘ছায়া তথ্য প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকায়। তার ইশারা ছাড়া সরিষাবাড়িতে গাছের পাতাও নড়তো না। উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি প্রত্যেকটা দপ্তরে দাপিয়ে বেড়াতো মুরাদের নাম ভাঙিয়ে। টিআর, জিআর, কাবিখাসহ সরকারি বরাদ্দের হরিলুট, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবই হতো মুকুলের ইশারায়। কোনো কোনো প্রকল্পের তালিকাও তোইরি হতো তার নির্দেশে।

একের পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীরা এই বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত ও মারধরের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদের গুলির আঘাতে চোখের আলো হারিয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। লাঞ্ছিত হওয়া থেকে বাদ পড়েননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও।

কে এই মুকুল: তিনি সরিষাবাড়ি উপজেলার ভাটার ইউনিয়নের চৌখা গ্রামের শাহজাহান আলী শেখের ছেলে। একসময় যুবদল করতেন। জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে নবম জাতীয় সংসদে ডা. মুরাদ হাসান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাড়ির ফরমায়েশ খাটতেন দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই মুকুল। এক পর্যায়ে ওই বাড়ির কাজের মেয়ে মোর্শেদা আক্তারকে বিয়ে করেন তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দলকে কেন্দ্র করে মুকুলের নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পরই সরিষাবাড়িতে আলোচনায় আসে মুকুল। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

মুরাদের সঙ্গে মুকুল

ডা. মুরাদ হাসান পুনরায় এমপি নির্বাচিত ও প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হলে পুরো উপজেলায় একক আধিপত্য গড়ে তোলেন মুরাদের ছত্রছায়ায়। আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনে কোথাও কোনো পদ-পদবী না থাকলেও তার ইশারায় চলে নানা অপকর্ম। বর্তমানে চলাফেরা করেন অর্ধকোটি টাকার মূল্যের বিলাসবহুল ‘নোয়া’ ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকারে।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তরে আছে মুকুলের হাত। তার অনুমতি ছাড়া একটি প্রকল্পও তালিকাভুক্ত হয় না। এর মধ্যে ২০১৯ ও ২০২০ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) অফিসের অধীন বরাদ্দকৃত টিআর, জিআর, কাবিখা প্রকল্প সবগুলো মুকুলের পছন্দমতো নাম-তালিকা করা হয়েছে, যার ২০ ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। অতিদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০ দিনের কর্মসংস্থান (ইজিপিপি) কর্মসূচির দুই কোটি ৫৯ লাখ টাকার সিংহভাগ লুট করার অভিযোগ রয়েছে মুকুলের বিরুদ্ধে। করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণের প্রায় ৭শ’ মেট্রিক টন চাল ও নগদ প্রায় ৫০ লাখ টাকা এবং ভিজিএফ প্রকল্পের ২০২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয় সরকার। সেখানেও কোপ বসান এই মুকুল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বশীল সূত্র বাংলাদেশ জার্নালকে জানায়, বরাদ্দকৃত সহায়তাগুলো লোক দেখানো কিছু বিতরণ করা হলেও সিংহভাগ চাল গুদাম থেকেই উধাও হয়ে যায়। মুকুলের নেতৃত্বে এ হরিলুট হলেও কাগজে-কলমে এর দায়ভার পড়েছে পিআইও হুমায়ুন কবীরের ওপর।

অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয় রেকর্ডপত্র তলব করে সম্প্রতি পত্র দিয়েছে। এছাড়া সোলার হোম সিস্টেম ও ব্রিজ নির্মাণ কাজও মুকুলের পছন্দের লোকদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় ১৯৫টি ঘর বরাদ্দ করে সরকার। কয়েকটি ঘর বিনামূল্যে দেয়া হলেও বেশিরভাগ উপকারভোগীর কাছ থেকে ২০-৫০ হাজার টাকা করে উৎকোচ নিয়েছে মুকুল বাহিনী। টিনসেট পাকা ঘরগুলো নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্মাণের নিয়ম থাকলেও তা না করে নিম্নমানের ইট-সিমেন্ট দিয়ে মুকুলরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করছে।

সরিষাবাড়ির কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিআইও অফিসের সকল দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি করা হয়েছে। মাস্টাররোলে একই সুবিধাভোগীর নাম ৫ থেকে ১০ বার দেখানো হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুকূলে প্রকল্প বরাদ্দ হলেও তারা ভালো-মন্দ কিছুই জানেন না। শুধুমাত্র স্বাক্ষর নেয়া হয় তাদের। ক্যাডারদের ভয়ে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করে যান তারা। ভবিষ্যতে দুদক ডাকলে হয়রানি হতে হবে চেয়ারম্যানদেরই।

শুধু পিআইও অফিসই নয়, উপজেলা খাদ্য গুদাম, স্থানীয় সরকার বিভাগ, কৃষিদপ্তর থেকে শুরু করে সর্বত্রই মুকুলের আধিপত্য। সাখাওয়াতুল আলম মুকুল খাদ্য গুদামে নিজেকে কৃষক প্রতিনিধি হিসেবে নাম দিয়েছেন। ধান সংগ্রহ অভিযানের সমস্ত ধান ডিলার রাজু মিয়ার মাধ্যমে তিনিই দেন। চাল সংগ্রহ অভিযানের ক্ষেত্রেও ভুয়া চাতালকলের তালিকা বানিয়ে সব চাল একাই দেন। সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও তা উপেক্ষা করায় বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত কৃষক।

চলতি বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি পুনর্বাসনের আওতায় ১৭ হাজার ৩৩০ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ভুয়া তালিকা করে বেশিরভাগই মুকুলের পছন্দের লোকদের দেয়া হয়। কোনো কোনো কৃষককে সার-বীজ বিক্রি করে নামেমাত্র কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় ও পৌরসভার সকল টেন্ডারও মুকুল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এডিপিসহ সকল উন্নয়ন কাজের টেন্ডারে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঠিকাদারদের দরপত্র প্রত্যাহার করানো হয় এবং পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নামেমাত্র কার্যাদেশ দেখিয়ে মুকুল ও তার লোকজন নিম্নমানের কাজ বাস্তবায়ন করে আসছে।

এছাড়া দেশের সর্ববৃহৎ যমুনা সার কারখানা এলাকায় প্রতিদিন চলছে নীরব চাঁদাবাজি। প্রতিবস্তা সার পরিবহন বাবদ দুই টাকা হারে প্রতিমাসে অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি করে আসছে মুকুল। এছাড়া সিবিএ’র মাধ্যমে কারখানার ভেতরে চাঁদাবাজি, উৎকোচ বাণিজ্য, দৈনিক হাজিরাভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যও কথিত ওই বাহিনীর হাতে। এমনকি যমুনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের নিয়ন্ত্রকও ক্ষমতাশালী এই মুকুল বাহিনী। বর্তমানে উপজেলার শতাধিক স্পটে অবৈধ ড্রেজার মেশিন চলে। প্রতিটি মেশিন থেকে প্রতিমাসে মুকুলকে দিতে হয় ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর যমুনাপাড়ের মানুষের দিন কাটে ভাঙন আতঙ্কে।

অভিযোগ রয়েছে, মুকুল বাহিনীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। বাস টার্মিনাল এলাকায় মুকুল গড়ে তুলেছেন তার নিয়ন্ত্রণ অফিস। এ অফিস, শিমলাপল্লীর বাসা ও আশেপাশে জমা করে রেখেছেন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। যা তার বাহিনীর সদস্যরা প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করে। তার বাহিনীর সদস্য সাবেক ছাত্রদলকর্মী শরিফ আহাম্মেদ নীরব, বিএনপি থেকে আসা একসময়ের দুর্ধর্ষ ক্যাডার বেলাল হোসেন, এমডি রানা সরকার, সামিউল ইসলাম সামির, জিএস রাজন, মহিউদ্দিন ওরফে সুমন চাকলাদার, রাজন স্বপন উল্লেখ্যযোগ্য। মুকুল বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশই বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারী হওয়ায় এদের হামলার হাত থেকে রেহাই পাননি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে তারাকান্দিতে বিজয় দিবস পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। এ সময় সাখাওয়াত আলম মুকুলের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডাররা সেখানে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে মুকুল বাহিনী রফিকুল ইসলামের লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় বিজয় দিবসের মঞ্চ ও সেখানে টাঙানো বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন গুলিবিদ্ধ ও তারাকান্দি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ তরিকুল ইসলামসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিজয় দিবস উদযাপনের মঞ্চে মুকুল বাহিনী বিনা কারণে হামলা করে। তাদের গুলিতে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল থেকে চক্ষু হাসপাতালে স্থানান্তর ও চোখের জটিল অপারেশন করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি চোখ ফিরে পাবেন কি-না, চিকিৎসকরা এখনো বলতে পারছেন না।

জানা গেছে, একইভাবে মুকুল বাহিনী ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল-আমিন হোসাইন শিবলুর ওপর হামলা করে। সেদিন পৌরসভার সামনে শিবলুকে একা পেয়ে বেধড়ক মারধর করে তারা। দীর্ঘদিন তিনি রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ ঘটনায় সরিষাবাড়ী থানায় মামলা (নম্বর ১৪) দায়ের হলে আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়। ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে মামলার চার্জশিট দেয়নি পুলিশ।

গত বছরের ১৩ জানুয়ারি মুকুল বাহিনী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সদস্য আব্দুর রাজ্জাককেও মারধর করে। উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের চর সরিষাবাড়ীর জিগাতলা এলাকায় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের একটি অনুষ্ঠান চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। পরে বিষয়টি নিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান কৃষিমন্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে হামলাকারীদের কোনো শাস্তিই হয়নি।

চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি (শনিবার) রাতে জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক ও সরিষাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন পাঠানকে তারই বাড়িতে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে মুকুল ও তার ক্যাডার বাহিনী। মুকুল বাহিনীর অত্যাচার থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের রক্ষায় সিনিয়র নেতারা সদ্যসাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের কাছে দাবি জানালে এ ঘটনা ঘটে। পরে মুরাদ হাসান সিনিয়র নেতাদের তোপের মুখে বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন পাঠানের পায়ে ধরে ক্ষমা চান।

গত ১ ফেব্রুয়ারি উপজেলার শিমলাবাজারের ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল হক তরফদারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, স্বর্ণালঙ্কার লুট ও নারীসহ অন্তত ১০ জনকে মারধর করে এই বাহিনী। পরাজিত প্রার্থী কালাচান পালকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য চার লাখ টাকা চুক্তি নিয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা এ ঘটায় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজেলার ইস্পাহানী আবাসিক মন্দিরে সরস্বতী পূজা চলাকালে মণ্ডপে হামলা চালায় এই মুকুল বাহিনী। এতে অন্তত ১৫ জন আহত ও মণ্ডপের মঞ্চ তছনছ হয়ে যায়।

এছাড়া তাদের হাতে শিমলাবাজারের ব্যবসায়ী রাজু আহমেদের ওষুধ ও প্রিন্টার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও লাঞ্ছিত হন। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিন্দানুর, ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম ও পিডিবি অফিসের দেলোয়ারসহ কয়েকজন কর্মচারী মারধরের শিকার হন। উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদুল কবীর শামীম ও সাবেক মেয়র ফয়েজুল কবীর শাহীন কয়েকবার লাঞ্ছিত হন।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, কৃষি প্রণোদনা দাবি করাকে কেন্দ্র করে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিন্দানুরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে মুকুল সাহেবই বিষয়টি সমঝোতা করেন।

পিডিবি’র কর্মচারী বশির উদ্দিন বলেন, রুটিনমাফিক বিদ্যুতের লোডশেডিং দেয়ায় মুকুল ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে পিডিবিতে এসে কয়েকজনকে মারধর করেন। এজন্য সদ্যসাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফোন করে সরিও বলেন।

এদিকে মুকুল বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল চুরি সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করায় গত বছরের ১০ এপ্রিল রাতে মুকুলের নেতৃত্বে আনন্দ টিভির উপজেলা প্রতিনিধি নাসিম উদ্দিনের বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীর সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের সহায়তায় নাসিম উদ্দিনকে মধ্যরাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় ও সাংবাদিকতা বাদ দেয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়। এরপর কারও সহযোগিতা না পেয়ে এলাকা ছেড়ে তিনি টাঙ্গাইল শশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে সাংবাদিক নাসিম উদ্দিন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, একসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। কিন্তু দুর্নীতির নিউজ করায় শেষ পর্যন্ত আমাকেই দেশদ্রোহী বানিয়ে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। অনেক আকুতি-মিনতি করেও সেদিন লাভ হয়নি। সেই রাতের কথা মনে হলেই আতকে উঠি।

শুধু নাসিম উদ্দিনই নয়, চাল চুরির সংবাদকে কেন্দ্র করে একাত্তর টিভির উপজেলা প্রতিনিধি মমিনুল ইসলাম কিসমতকে এই বাহিনী একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি দেয়। যমুনা সার কারখানার দুর্নীতি-চাঁদাবাজির সংবাদ প্রকাশ করায় লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও ভোরের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার দুলাল হোসাইনকে। নেতিবাচক সংবাদ লেখায় প্রেসক্লাবসহ স্থানীয় গণমাধ্যম সংগঠনগুলোতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এই বাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সংবাদকর্মী জানান, সংবাদকর্মীদের স্বার্থেই তথ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর এলাকাতেই গণমাধ্যমকর্মীদের আতঙ্কে থাকতে হতো।

এদিকে মুকুল বাহিনীর প্রধান সাখাওয়াত আলম মুকুলের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগও রয়েছে। চাকরির লোভ দেখিয়ে সহজ-সরল নারীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করেন তিনি। মুরাদের পদত্যাগের পর এক নারীর সাথে মুকুলের পরকীয়ার অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জানা গেছে, ফেনী থেকে এক নারীকে প্রলোভনে সরিষাবাড়ীতে এনে বাস স্ট্যান্ডের এক বাসায় মুকুলের ক্যাডার বেলালের আশ্রয়ে রাখা হয়েছিল।

অপর এক অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৯ সালের ৮ জুলাই তারাকান্দি গ্রামের এক যুবকের (৩৪) সাথে মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজে পড়ুয়া মহিষাকান্দি গ্রামের এক যুবতীর বিয়ে হয়। শশুরবাড়ি থেকে কলেজে যাতায়াতের এক পর্যায়ে ওই যুবতীর প্রতি মুকুলের নজর পড়ে। তাকে চাকরির লোভ দেখিয়ে কৌশলে সম্পর্কে জড়ায়। এদিকে মুকুলের সাথে ওই মেয়েটির মুঠোফোনে ভিডিও কলের আপত্তিকর দৃশ্য ও কল রেকর্ড স্বামীর কাছে ধরা পড়ে। এ ঘটনা মেয়েটির স্বামী সহ্য করতে না পেরে গত ২০২০ সালের ১৬ জুলাই তাকে তালাক দেন। এরপর মুকুল ওই মেয়েকে দিয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে যৌতুক আইনে মামলা (যার নম্বর ১৬৩ (১) ২০২০) দায়ের করেন। ঘটনাটি জানাজানি হলে মুকুল তার ক্যাডার বাহিনীর সশস্ত্র মহড়া দিয়ে ওই মেয়েকে স্বামীর বাড়িতে রেখে আসে। এরপর ওই যুবকের মা সরিষাবাড়ী থানায় একটি জিডি (যার নম্বর ৯৮৫) দায়ের করেন। জিডিতে বাদী অভিযোগ করেন, ‘ওই মেয়ে ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে তিনি ও তার ছেলের বাড়িতে যেতে পারছেন না।’

এমনই নানা ঘটনা ঘটিয়ে মুরাদের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল মুকুল বাহিনী। মুরাদের পদত্যাগের খবরে মুকুল বাহিনীর ক্যডাররা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সরিষাবাড়িতে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে।

এ সকল অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে সাখাওয়াত আলম মুকুল বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি ত্রাস নই। আমার কোনো বাহিনীও নেই। আর যে গাড়িটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটি আমি ব্যাংক লোন করে কিনেছি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশা বলেন, সাখাওয়াত আলম মুকুল নামে কেউ আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে নেই। কিন্তু দলের নাম ভাঙিয়ে তার নেতৃত্বে যা হয়েছে, তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। মুকুলের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ জানান, মুকুল এতদিন দলের নাম ভাঙিয়ে মুরাদ হাসানের ছত্রছায়ায় সরিষাবাড়ীতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ভীতি সঞ্চার করেছিলো। অথচ দলের জন্য তার কোনো অবদানই নেই। তার জন্য আমরা বিব্রত।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত