ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

পুকুরহীন জামালপুর শহর এবং কিছু কথা

  শওকত জামান

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২, ২২:২৪

পুকুরহীন জামালপুর শহর এবং কিছু কথা

জামালপুর শহরের প্রত্যেক পাড়া মহল্লায় একের অধিক পুকুর ছিল। পুকুরগুলোতে ছিল সান বাঁধানো ঘাট। পুকুরে সব বয়সি মানুষের গোসল করা, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাটতো। সারাদিন কোলাহল মুখর হয়ে থাকতো পুকুর ঘাট। বাবা-মায়েরা সন্তানদের সাঁতার শেখাতো পুকুরের পানিতে। পুকুরঘাট থেকে লাফ দেয়া ও পুকুরে সাঁতার কেটে দুরন্তপনায় মেতে থাকতো শিশু কিশোররা। আজো সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে পড়লে স্বৃতিকাতর হয়ে উঠি। দৃশ্যপটগুলো সাদাকালো জলছবি হয়ে রয়েছে স্বৃতির মনিকোঠায়। কংক্রিটের এই শহরে ইটপাথরের চাপায় হারিয়ে গেছে সোনালী অতিতের সেই পুকুরগুলো।

গত এক দশকে হঠাৎ করে জমির দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় জমি ব্যবসায়ী নামের ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের আগ্রাসনে কৃষিজমি, খাল-বিল ভরাট হওয়ার সাথে সাথে ভরাট হয়ে গেছে শহরের পুকুরগুলো। অবশিষ্ট থাকা দু'চারটি পুকুর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। যেকোন সময় সেগুলোও ভরাট হয়ে যাওয়ার শংকায় রয়েছে।

কৃষি জমি, নদী, খাল-বিল ও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গণমাধ্যমে একাধিকবার এ বিষয়ে কথা বলেছেন এমনকি নদী, খাল-বিল, কৃষি জমি ও পুকুর ভরাট করে কোন স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না মর্মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণও করেছেন। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে জামালপুর শহরের নদী-নালা, খাল-বিল, ৩ ফসলি কৃষি জমি ও পুকুর একের পর এক ভরাট করে গড়ে তুলেছেন বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা। এসব বিষয়ে বিধিনিষেধ প্রয়োগের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারাও তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব শিঁকেই তুলে করেছেন পকেট ভারী। ফলে একের পর এক শহরের পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় নতুন প্রজন্মের শিশুরা সাঁতার শেখার সুযোগ পাচ্ছে না। এ প্রজন্মের ৯৯% শিশু সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে।

সাঁতার শিশুদের শাররিক ও মানুষিক বিকাশ ঘটে। সাঁতার জানা থাকলে বন্যা ও নৌকাডুবির মতো দূর্যেোগ মোকাবেলা করে নিজেকে আপদকালীন সময়ে রক্ষাও করতে পারে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় নতুন প্রজন্মের শিশুর সাঁতার শেখার কোনই সুযোগ নেই।

শহরের কোন এলাকায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নেভাতে কাছাকাছি থাকা পুকুরের পানি সহায়ক ভূমিকা রাখতো। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে থাকা সিমিত পানি দিয়েতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আগুন নেভানো সম্ভব নয়। পাড়া-মহল্লায় পুকুর না থাকায় এই সময়ে কোথাও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে চোখের সামনে সম্পদ পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া কিছুই করার সুযোগ থাকবে না।

খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়ার একটু বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় জামালপুর শহর। পানি নিষ্কাশন সংকুচিত হয়ে পড়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে হাঁটুপানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আগে দীর্ঘমেয়াদী বৃষ্টি হলেও বৃষ্টির পানি পুকুর খাল-বিল হয়ে নদীতে চলে যেত। জলাবদ্ধতার সাথে জামালপুর শহরবাসী পরিচিত ছিল না। অপরিকল্পিত নগরায়নও জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অনেকাংশে দায়ী। জলবদ্ধতা নিরসনে জামালপুর পৌরসভা শহরজুড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তবে অবিবেচক মানুষজন বাসাবাড়ি বা স্থাপনা নির্মাণে রাস্তা ও ড্রেনের পাশে বা উপরে ইট বালিসহ নির্মাণসামগ্রী রাখায় ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে পয়ঃনিষ্কাশন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। পৌরসভা থেকেও নিয়মিত ড্রেনগুলোর পরিস্কার হয় না। এ ব্যাপারে পৌর কাউন্সিলরদের মনিটরিং করার জন্য পৌর মেয়রের প্রতি অনুরোধ রইলো।

শহরের পানি নিষ্কাশনের বড় দুটি মাধ্যম হলো বংশখাল ও গবাখালি খাল। এই মধ্যে এক সময়ের খরস্রোতা বংশখাল ভূমিলোভী অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে সরু ড্রেনে পরিনত হয়েছে। প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা উচ্ছেদ করে বংশখাল সরু ড্রেন থেকে আগের রুপে খালে পরিনত করতে পারলে জলবদ্ধতার হাত থেকে অনেকাংশেই জামালপুরবাসী মুক্তি পেতো। তবে এ কাজটি বড়ই কঠিন, দুরুহু ব্যাপারও বটে। ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় সেনাবাহিনী উচ্ছেদে হাত দিয়েছিল কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি, দখলদাররা এতই প্রভাবশালী বুঝতেই পারছেন? গবাখালী খাল আংশিক পরিষ্কার হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। শেখের ভিটা রেলগেইট থেকে বেলটিয়া হয়ে কালিবাড়ি সুইসগেট পর্যন্ত পরিস্কার হলে শহরের বৃষ্টির পানি সহজেই নেমে যাবে।

এবার মূল আলোচনায় আসি। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে হলে তাদের সাঁতার শেখার ব্যবস্থার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুরা সাঁতার শেখার সুযোগ পেলে যেমনি মানষিক ও শাররিক বিকাশ ঘটবে, তেমনি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হারও কমে আসবে। প্রয়োজন বাস্তব মুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

শহরের পুকুরগুলো উদ্ধার করে শিশুদের সাঁতার শেখার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে প্রশাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে শহরের বেশকটি স্থানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর বা সুইমিংপুল গড়ে তোলা যেতে পারে। পুকুর বা সুইমিংপুল গড়ে উঠলে অর্থ ব্যয় করে হলেও অভিভাবকরা সন্তানদের সাঁতার শেখাতে উদ্যোগী হবে। এতে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎসেরও সম্ভবনা রয়েছে। আজকের শিশু আগামীর ভবিষৎ।

লেখক: শওকত জামান, গণমাধ্যমকর্মী

  • সর্বশেষ
  • পঠিত